‘চার খলিফা’ খ্যাত ছাত্রনেতাদের অন্যতম ছাত্রলীগ এর সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী
নূরে আলম সিদ্দিকী (জন্ম ১৯৪৪) ‘চার খলিফা’ খ্যাত ছাত্রনেতাদের অন্যতম, ছাত্রলীগ এর সভাপতি, ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, কিংবদন্তী বাগ্মী, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কারাবন্দি, দীর্ঘকাল রাজনীতিতে প্রায় নিষ্ক্রিয়, বর্তমানে নিজ ব্যবসায় মনোনিবেশকারী ও প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক।
১৯৪৪ সালের ২৬শে মে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার তালিবপুর গ্রামে মাতুলালয়ে নূরে আলমসিদ্দিকীর জন্ম। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি মুর্শিদাবাদের কবন্দি গ্রামে। দেশ বিভাগের পর তাঁদের
পরিবার যশোরের ঝিনাইদহে চলে আসে। তাঁর পিতার নাম নূরুন্নবী সিদ্দিকী এবং মাতার নাম নূরুন্নাহার সিদ্দিকী। তাঁর পিতাও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ছিলেন।
নূরে আলম সিদ্দিকী মুর্শিদাবাদের কবন্দি গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ঝিনাইদহে এসে এখানকার মডেল হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে তিনি ঝিনাইদহ কেশব চন্দ্র পাল (কে সি পাল) কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তিনি ঢাকা কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নকালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের তাবেদার পূর্ব বাংলার গভর্নর মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভে সক্রিয় ভূমিকা পালনের কারণে তাঁকে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অতঃপর তিনি জগন্নাথ কলেজে একই কাসে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৭০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন।
স্কুলজীবন থেকেই নূরে আলম সিদ্দিকীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলনে (১৯৬২) সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জনগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ছাত্র-রাজনীতির অগ্রভাগে চলে আসেন। ৬৪-র হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এ আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান, ৭০- এর নির্বাচনী প্রচার, ৭১-এর ২-২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন, সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ৬- দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর তিনি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং ৬ই আগস্ট ১৯৬৬ কারারুদ্ধ হয়ে এক নাগাড়ে ১৭ মাস বন্দিজীবন কাটান। সে-সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর নিকটবর্তী ২০নং সেলে ছিলেন। কারাগারে থাকাকালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থের একাধিক স্থানে নূরে আলম সিদ্দিকীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। ১৯৬৮ সালের শুরুতে তিনি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং শাজাহান সিরাজ- সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর আ স ম আবদুর রব- ডাকসু-র সহ-সভাপতি এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন- সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৭০-এর নির্বাচনোত্তর বাঙালি সত্তার স্ফুরণ-পর্বে ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে উত্থান ঘটে ‘চার খলিফা’ খ্যাত এ চতুষ্টয় নেতৃত্বের। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন চত্বরের ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রদর্শন, ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ২৩শে মার্চ পল্টন ময়দানে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ এবং এরপর মিছিল সহকারে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গমন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে তিনি সভাপতিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- থেকে একাধিকবার তাঁর বক্তৃতা প্রচারিত হয়। তিনি তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারাও প্রভাবিত হন। তিনি উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে এবং বামপন্থী রাজনীতির ঘোর বিরোধী। ১৯৭৩ সালে তিনি যশোর ২ আসন থেকে -আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর তাঁকে মোশতাক-জিয়া সরকার কারাবন্দি করে। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করা হলে তিনি এ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অকৃতকার্য হন। বর্তমানে তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। সেকালের রাজনীতি ও ছাত্রলীগ (ঢাকা, বেহুলা বাংলা ২০১৯) নামে তাঁর একটি গন্থ রয়েছে। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি ১ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম পারভীন আলম। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড