You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্ৰ সিংহ - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্ৰ সিংহ

নূতন চন্দ্ৰ সিংহ (১৯০০-১৯৭১) কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, বিদ্যোৎসাহী, নারীশিক্ষার অগ্রপথিক, সমাজ সংস্কারক, দানবীর, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এবং স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত। চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী রাউজান সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকা। এ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন বহু খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে বরোদা চরণ ধর, মাস্টার দা সূর্যসেন, খান বাহাদুর ফরিদ আহমদ, রায় বাহাদুর রামকমল ঘোষ, নবীন চন্দ্র মহাজন, ড. বেণীমাধব বড়ুয়া, ব্যারিস্টার অরবিন্দু বড়ুয়া, এডভোকেট ফণীভূষণ বড়ুয়া, খান সাহেব আব্দুল জব্বার চৌধুরী, খান সাহেব আব্দুল করিম, কবি নবীন চন্দ্র সেন, সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের, সুধাংশু বিমল বড়ুয়া, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, ভাষাকন্যা প্রতিভা মুৎসুদ্দি, ভাষাসৈনিক মাহবুবুল আলম চৌধুরী, আব্দুল হক চৌধুরী, অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
নূতন চন্দ্ৰ সিংহ ১৯০০ সালের ১লা ডিসেম্বর রাউজানের গুজরায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা অখিল চন্দ্র সিংহ এবং মাতা গয়েশ্বরী সিংহ। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই। তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তিনি স্থানীয় পাঠশালা ও চট্টগ্রামের জগৎপুর আশ্রমে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯১৮ সালে রাউজানের সর্তা গ্রামের মনোরমা সিংহের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর তিন ছেলে চিত্ত সিংহ, সত্য সিংহ, প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ ও এক মেয়ে রাণী প্রভা সিংহ।
নূতন চন্দ্র সিংহ চট্টগ্রামে নারীশিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি রাউজানের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নারীশিক্ষার অগ্রপথিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির (১৯৬০), কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় (১৯৬৯), কুণ্ডেশ্বরী আয়ুবের্দ কলেজ, কুণ্ডেশ্বরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মনোরমা ছাত্রী নিবাস, যা আজো সগৌরবে তাঁর কীর্তি বহন করছে। এছাড়াও তিনি গহিরা হাইস্কুল, গহিরা কলেজ, রাউজান কলেজ, রাউজান স্কুল, হাটহাজারী কলেজ, বাঁশখালী কলেজ, ফতেয়াবাদ কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহায়তা প্রদান করেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি বার্মা (বর্তমান মায়ানমার)-এর আকিয়াবে গিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি সাবান ও আয়ুবের্দীয় ঔষধ তৈরির ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত ধন-সম্পদ ত্যাগ করে তিনি চট্টগ্রামে চলে আসেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি নিজ গ্রাম গহিরায় কুণ্ডেশ্বরী আয়ুর্বেদ ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে মানব সেবার ব্রত নিয়ে তিনি ১৯৫৪ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আয়ুবের্দীয় প্রতিষ্ঠান কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় লি. প্রতিষ্ঠা করেন। সাধারণের কল্যাণে তিনি গঠন করেন কুণ্ডেশ্বরী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, যা থেকে প্রতিবছর ‘নূতন চন্দ্র সিংহ’ বৃত্তি ও গুণীজন সম্মাননা প্রদান করা হয়। সমাজ সংস্কারক ও দাতা হিসেবে তিনি সকলের নিকট সমধিক পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮টি পরিবারসহ অন্যান্য বহু সাধারণ মানুষকে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দেন এবং ভারতে চলে যেতে সহায়তা করেন। ১১ই এপ্রিল বিকেলে আবদুল্লাহ আল নোমান (বর্তমান বিএনপি নেতা) ও কমরেড ফরহাদ হোসেন কুণ্ডেশ্বরীতে গিয়ে তাঁকে ভারতে চলে যেতে অনুরোধ করেন। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানও তাঁকে দেশ ত্যাগের জন্য বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাঁর কথা ছিল, ‘আমিতো কারো ক্ষতি করিনি। জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি। এই শেষ বয়সে নিজের দেশ আর আরাধ্যা দেবী কুণ্ডেশ্বরীকে ছেড়ে কোথাও যাব না। যদি মরতে হয় এখানেই মরব। এখানে যদি মৃত্যু হয় তাহলে জানব এই-ই আমার নিয়তি, এই-ই মায়ের ইচ্ছা।’ অতঃপর অন্যরা সেখান থেকে দুটি জিপে করে গহিরা চৌমুহনী হয়ে ফটিকছড়ির দিকে রওনা দেন। পথে রাত হয়ে যাওয়ায় মির্জা আবুর বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরদিন ১২ই এপ্রিল তাঁরা রামগড় হয়ে ভারতের সাক্ৰমে পৌছান।
১৩ই এপ্রিল স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে নূতন চন্দ্র সিংহের বাড়িতে আসে। তাদের সঙ্গে ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। নূতন চন্দ্র সিংহ পাকসেনাদের অভ্যর্থনা জানান। তিনি তাদের বোঝতে চেষ্টা করেন তিনি কী কাজ করেছেন, আরো কী কাজ করতে চান। তাঁর কথা শুনে পাকসেনারা চলে যায়। কিন্তু সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাদের ফিরিয়ে আনে এবং নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা করতে প্ররোচিত করে। তখন পাকসেনারা তাঁকে তিনটি গুলি করে। একটি গুলি চোখের নীচে বিদ্ধ হয়, একটি তাঁর হাতে লাগে, আর তৃতীয় গুলিটি তাঁর বক্ষ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তিনি মায়ের নাম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ৩ দিন পড়ে থাকার পর তাঁকে দাহ করা হয়। উল্লেখ্য যে, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচারে সাক্ষীদের বক্তব্যে জানা যায়, হানাদাররা নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে থাকেন। এ সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার হাতে থাকা রিভলভার দিয়ে নূতন চন্দ্র সিংহের বক্ষে গুলি করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে। মামলার বিচারে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় হয় এবং ২০১৫ সালের ২২শে নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ঐ রায় কার্যকর করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান ও আত্মোৎসর্গের জন্য দেশপ্রেমিক শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর)-এ ভূষিত করে। রাউজানের গ্রামের বাড়িতে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [জগন্নাথ বড়ুয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড