You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.09 | নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ড যুদ্ধ (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ড যুদ্ধ (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম)

নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ড যুদ্ধ (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ৯-১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরপক্ষে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই পাকিস্তানি সেনারা নাজিরহাট কলেজে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ৮ই ডিসেম্বর ফটিকছড়ি থানা অপারেশনের পর এ ক্যাম্পে অপারেশন পরিচালনার প্রস্তুতি নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ই ডিসেম্বর ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুর থেকে জোনাল কমান্ডার মীর্জা মনসুর, হিরাম ক্যাম্প থেকে লে. শওকত ও ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে রেগুলার আর্মির একটি গ্রুপ নাজিরহাটের দিকে রওনা হয়। তাঁরা নাজিরহাট যাবার সময় স্থানীয় বিভিন্ন গ্রুপ কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়ে যান যে, তাঁরাও যেন নাজিরহাট বাজারে চলে যান। এই নির্দেশ পেয়ে গ্রুপগুলো দুপুর একটার দিকে নাজিরহাট বাজারের দিকে রওনা দেয় এবং দেড় ঘণ্টার মধ্যে একে-একে প্রতিটি গ্রুপ নাজিরহাট মাদ্রাসার সামনে গিয়ে জড়ো হয়। বিকেল ৪টার দিকে বিএলএফ কমান্ডার সৈয়দ শরফুল হোসাইন তাঁর গ্রুপ নিয়ে নাজিরহাট ব্রিজ পার হয়ে পেট্রোল পাম্পের বিপরীত দিকে একটি পুকুরপাড়ে অবস্থান নেন। ইতোমধ্যে লে. শওকতের নেতৃত্বাধীন এক প্লাটুন আর্মি পেট্রোল পাম্পের সামনের চত্বরে পজিশন নেয়। নিকটেই নাজিরহাট রেল স্টেশন। স্টেশন মাস্টার ছিল একজন বিহারি। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলাতে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে বাঙালি মনে করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর তাকে চিনতে পারেন এবং তাঁর সঙ্গে এক পর্যায়ে সে (স্টেশন মাস্টার) বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে কিছুদূর চলে আসার পর লোকটি টেলিফোনে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেয়।
ঐদিন ফটিকছড়ি থানার রোসাঙ্গীরি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ঐ এলাকায় অবস্থানরত অনেক মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হন। সেখান থেকে তাঁরা বিকেলে নাজিরহাট এসে পৌছান। চতুর্দিক থেকে আরো মুক্তিযোদ্ধারা এসে নাজিরহাটে জমায়েত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হাজার-হাজার জনতাও হানাদারমুক্ত নাজিরহাট বাজারে উল্লাস করতে থাকে। তখন প্রায় মাগরিবের নামাজের সময়। আনন্দ-উল্লাসের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হাটহাজারী থেকে এসে হাটহাজারী থানা সীমান্তে নাপিতের ব্রিজের কাছে বাস থেকে নেমে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারাও নিজ-নিজ পজিশন নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এ সময় আরো দুটি বাস এসে পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি থামে। এর প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে ৩টি ট্রাক দেখা যায়। পজিশন নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা আবছা অন্ধকারে সব দেখছেন। এর মধ্যে হঠাৎ ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শোনা যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা নিজ-নিজ অবস্থান থেকে ফায়ার শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর দুটি গাড়ি থেকে কিছু পাকিস্তানি সৈন্য লাফিয়ে পড়ে পজিশন নেয় এবং গুলি করতে থাকে। এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন বিএলএফ কমান্ডার সৈয়দ শরফুল হোসাইন, এলএমজি ম্যান সিরাজুল ইসলাম, আবু ইউসুফ, জিয়াউল কবির, শামীম প্রমুখ। এ সময় হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নাজিরহাট বাসস্টেশনে শহীদ হন। শহীদদের একজন বাদে বাকি ১০ জনের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন- সিপাহি মানিক মিয়া (চট্টগ্রাম), ফোরক আহমদ (চট্টগ্রাম), তোফাজ্জল হোসেন (বরিশাল), সিপাহি অলি আহমদ (খুলনা), সিপাহি নূরুল হুদা (কুমিল্লা), সিপাহি মোহাম্মদ ইসলাম (সন্দ্বীপ), আবদুল মিয়া (ফরহাদাবাদ, চট্টগ্রাম), মুজিবুল হক (ফরহাদাবাদ, চট্টগ্রাম), সিপাহি নূরুল আবছার (ফরহাদাবাদ), হাসিনা খাতুন (ফরহাদাবাদ, চট্টগ্রাম)। পরে এঁদের বাসস্ট্যান্ডের নিকট সমাহিত করা হয় এবং তাঁদের স্মরণে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। নামফলকে লেখা আছে ‘ওরা ১১ জন’।
এদিকে হানাদারদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন এবং নাজিরহাট বাজারে সমবেত জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে চতুর্দিকে দৌড়াতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় একত্রিত হয়ে হালদা নদী পার হয়ে মাদ্রাসার সন্নিকটে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেন এবং সারারাত হানাদারদের লক্ষ করে ফায়ার অব্যাহত রাখেন।
১০ই ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করে নাজিরহাট ব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থান নেয়। একই সঙ্গে নাজিরহাট কলেজেও তারা অবস্থান নেয় এবং নাজিরহাট বাজার দখল করে নেয়। ঐদিন বিকেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশন লক্ষ করে ২ ইঞ্চি মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও গুলি করে তার জবাব দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন পজিশন থেকে সারাদিন ও সারারাত পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে এভাবে গুলি বিনিময় চলে। ঐদিন সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় <মিত্রবাহিনী। পরদিন ১১ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নাজিরহাট ব্রিজের দুটি স্প্যান ধ্বংস করে দেয়, যাতে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা সেদিকে আসতে না পারেন। সেই সঙ্গে নাজিরহাট বাজার জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের সমস্ত পজিশন উঠিয়ে নিয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাত্রা করে। মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর পেয়ে হালদা নদী পার হয়ে তাদের আক্রমণ করেন। মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এ সময় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন লে. শওকত, সৈয়দ শরফুল হোসাইন, ইউসুফ (মিরসরাই), জাহাঙ্গীর আলম (চান্দগাঁও, প্রাক্তন শহর কমান্ডার), বিএলএফ নেতা এস এম ইউসুফসহ ফটিকছড়ি উপজেলার সব কয়টি গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। এখানে যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [জামাল উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড