You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.04 | নাগদা যুদ্ধ (মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

নাগদা যুদ্ধ (মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর)

নাগদা যুদ্ধ (মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর) সংঘটিত হয় ৪ঠা ডিসেম্বর। এতে পাকিবাহিনীর কমান্ডারসহ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় একজন পথচারী শহীদ এবং কয়েকজন সাধারণ মানুষ আহত হন।
নাগদা গ্রাম মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদর থেকে ৪ কিমি পূর্ব দিকে ৩নং খাদেরগাঁও ইউনিয়নের নারায়ণপুর-মতলব আঞ্চলিক সড়কের পাশে অবস্থিত। ৪ঠা ডিসেম্বর এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকিবাহিনীর কমান্ডারসহ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়। বাকিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় একজন পথচারী শহীদ এবং কয়েকজন সাধারণ মানুষ আহত হন। উভয় পক্ষের গুলিবর্ষণে বাড়িঘর ও নাগদা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশকিছু গবাদি পশু মারা যায়।
কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১৩-১৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য অবরুদ্ধ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে না গিয়ে গ্রামীণ রাস্তা ধরে ঢাকার দিকে রওনা করে। তাদের সঙ্গে হাল্কা ও ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদ, গুলির কার্টুন, বিস্কুট, চিনি, সিগারেটসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী ছিল। তারা হাজীগঞ্জ থানা থেকে কোনাকুনিভাবে স্থানীয় খোদাই বিল হয়ে মতলব থানার নাগদা গ্রামে প্রবেশ করে আরব আলী প্রধানীয়ার বাড়িতে আসে। সকাল ৯টার দিকে তারা দেওয়ানজি বাড়ি অতিক্রম করে বিলের মধ্য দিয়ে সলিম উদ্দিন বেপারী বাড়িতে প্রবেশ করে। সশস্ত্র হানাদার বাহিনীর উপস্থিতি দেখে বেপারী বাড়িসহ পশ্চিম দিকের সর্দার বাড়ি, উত্তর দিকের মিয়াজী বাড়ি, তালুকদার বাড়ি, দক্ষিণ দিকের প্রধানীয়া বাড়ির বৃদ্ধ, যুবক, মহিলা ও শিশুরা ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে দূরে চলে যায়। খালি বাড়ি পেয়ে পাকসেনারা কয়েকটি ঘরের মেঝেতে গর্ত খোঁড়ে, বাড়ির সুপারি বাগান কেটে বাংকার খোঁড়ে, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলা করার জন্য পজিশন নেয়।
নাগদা গ্রামে পাকসেনারা প্রবেশ করছে এ খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুক্তিযোদ্ধারা তা জানতে পারেন। বোয়ালিয়া বাড়ি ক্যাম্প, খিদিরপুর ক্যাম্প, বহরী কাজী বাড়ি ক্যাম্প, নওগাঁও ক্যাম্প, নিশ্চিন্তপুর ক্যাম্প ও মুন্সিরহাট ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বপ্রকার প্রস্তুতি নিয়ে নাগদা গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তাঁরা পাকবাহিনী অবস্থানরত সলিম উদ্দিন বেপারীর বাড়িটিকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেন। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু তারা তা না করে অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা থেমে-থেমে পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশল ছিল এভাবে তাদের দিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষণ করিয়ে তাদের গুলির ভাণ্ডার শেষ করে দেয়া। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের উর্দু ভাষা বুঝতে না পেরে মুন্সিরহাট ক্যাম্প থেকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটককৃত কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যকে নাগদা গ্রামে নিয়ে আসেন। যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধরত স্বদেশী সৈন্যদের উর্দু ভাষায় আত্মসমর্পণ করতে বললে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধবন্দি সৈন্যদের ‘মুক্তিকা দালাল’ বলে গালাগালি করতে থাকে আর গোলাগুলির তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দেয়। বিকেল পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর গুলির ভাণ্ডার শেষ হয়ে গেলে সন্ধ্যার দিকে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আত্মসমর্পণের পর আটককৃতদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। যুদ্ধে শহীদ আজিজুর রহমান (পিতা জালাল উদ্দিন পাটওয়ারী, নওগাঁও)-কে নিজ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। নাগদা ছৈয়াল বাড়ির আব্দুর রব যুদ্ধ চলাকালে প্রাণভয়ে বাড়ি থেকে পালানোর সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। নওগাঁও গ্রামের মিয়াজী বাড়ির (পুরাণ বাড়ি) আলী হোসেন মিয়াজী ও জসিম উদ্দিন তপাদার আহত হন। এ-যুদ্ধে নেকবর প্রধানীয়া (মুন্সিরহাট), জয়নাল আবেদীন প্রধান (শোভনকর্দি), সিরাজুল ইসলাম বকাউল (পৈলপাড়া), সাইদুর রহমান রতন (বহরী), নাছিরউদ্দিন পাটোয়ারী (মৈশাদী), লালু মিয়া (নওগাঁও), নুরুল ইসলাম (এনায়েতনগর), সামছুল হক তালুকদার (নাগদা-মিরামা) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। [তৌহিদুল আলম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড