নলখালি রেলসেতু অপারেশন (ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ)
নলখালি রেলসেতু অপারেশন (ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ) পরিচালিত হয় ১২ই সেপ্টেম্বর। এতে সেতুটি বিধ্বস্ত হয় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পাকসেনারা পার্শ্ববর্তী দুটি গ্রামে গণহত্যা চালায় ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
নারায়ণগঞ্জে অবস্থানরত পাকসেনারা নলখালি রেলসেতুর ওপর দিয়ে রেলযোগে ঢাকা থেকে অস্ত্র ও রসদ-সামগ্রী আনা-নেয়া করত। তাদের এ-কাজে বাধা দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা নলখালি রেলসেতু অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। ঘটনার দিন বিকেল ৫টার দিকে গ্রুপ কমান্ডার আলী হোসেনের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের এক বৈঠক হয়। রাত ১০টার দিকে ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ মোল্লা, কামাল হোসেন, খোরশেদ আলম, মো. মহিউদ্দিন মোল্লা, সবুজ হক, এহসান কবীর রঞ্জন, জয়নাল আবেদিন, মহিউদ্দিন আহমদ, আব্দুল মালেক, কলিমউদ্দিন মুন্সি, হজরত আলী, খালেক, ওহাব আলী, বদিউল আলম, সিদ্দিকুর রহমান, মফিজউদ্দিন, আয়েত আলী গাজী, ফজলুল হক, আলী আক্কাস, বদিউজ্জামান বদু এবং গোদনাইলের স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী মোহামসহ কয়েকজন এ অপারেশনে অংশ নেন।
অপারেশনের আগে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারেন যে, নলখালি রেলসেতুর কাছে ৭-৮ জন রাজাকার পাহারায় থাকে। এর ভিত্তিতে ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মতিন সিদ্ধান্ত নেন যে, সবাই একসঙ্গে অপারেশন স্থলে না গিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে জালকুড়ি গ্রাম থেকে রওনা হয়ে নামাপাড়া এসে পৌঁছান। মুক্তিযোদ্ধাদের দুই গ্রুপের নেতৃত্ব দেন ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মতিন এবং খোরশেদ আলম। খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা লামাপাড়ার পশ্চিমে রেললাইন ও রেলক্রসিংয়ের পূর্ব ঢাল ধরে সোজা দক্ষিণে ৬০-৭০ গজ দূরে অবস্থান নেন। তাঁরা নলখালি রেলসেতুর সামনে কয়েকজন রাজাকারকে দেখতে পান। রেলসেতুর কাছাকাছি গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মফিজউদ্দিন, মহিউদ্দিন, ফজলুল হক, আক্কাস আলী, ওহাব আলী, খালেক, সিদ্দিকুর রহমান, মহিউদ্দিন, কলিমউদ্দিন মুন্সি, আব্দুল মালেক, হামিদ মোল্লা, হযরত আলী, এহসান কবীর রঞ্জন, কামাল হোসেন, আব্দুল মতিন ও বদিউল আলম তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান এবং তাদের আটক করেন। এর মধ্যে একজন রাজাকার ফতুল্লার ক্যারোলিন মিলে পাকসেনা ক্যাম্পে খবর দেয়ার জন্য পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তা দেখে খোরশেদ আলম দু-তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করেন এবং তাকে ধরে ফেলেন। এরপর তাকেসহ অন্য রাজাকারদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে রেলসেতুর দুপাশে অবস্থান নেন। তাঁরা ১২০০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে পাঁচটি চার্জার তৈরি করেন। ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মতিন, মুক্তিযোদ্ধা আয়েত আলী গাজী, মহিউদ্দিন মোল্লা, ফজলুল হক, আব্দুল হামিদ, কামাল হোসেন, আলী আক্কাস ও বদিউজ্জামান বদু চার্জারগুলো নিয়ে দ্রুত রেলসেতুর চার কোণায় চারটি এবং মাঝের পিলারে একটি বসান। এরপর চার্জারগুলোর প্রেমাকড়ের পাঁচটি মাথা একত্র করে ডেটোনেটর বসিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসার পরপরই তা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় এবং রেলসেতুটি উড়ে যায়। বিধ্বস্ত সেতুর একটি টুকরো উড়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদের শরীরে বিদ্ধ হলে তিনি সামান্য আহত হন।
ইতোমধ্যে এ অপারেশনের খবর পাকসেনাদের ক্যাম্পে পৌঁছলে একদল পাকসেনা রেলসেতুর কাছে ছুটে আসে। কিন্তু তার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা বন্দি রাজাকারদের নিয়ে লামাপাড়া কবরস্থানে চলে আসেন। এখানে এসে তাঁরা রাজাকারদের অঙ্গীকার করান যে, তারা আর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবে না। রাজাকাররা এ অঙ্গীকার করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। অপারেশনের পরের দিন পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে নয়ামাটি ও কাইনপুর গ্রামে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে ২২ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং বহু ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ অপারেশনের খবর বিবিসি-তে প্রচারিত হয়। [রীতা ভৌমিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড