নসুখান ইটভাটা গণহত্যা (ফুলতলা, খুলনা)
নসুখান ইটভাটা গণহত্যা (ফুলতলা, খুলনা) সংঘটিত হয় ১৫ই এপ্রিল ও ২৯শে মে। এতে মোট ২৬ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
১৫ই এপ্রিল সকালবেলা যোগীপোল গ্রামের লিয়াকত আলী বেগের বাড়ির পূর্ব পাশে (বর্তমান খুলনা পুলিশ সেন্টারের সামনে) খুলনা-যশোর রোডের ওপর পাকহানাদার বাহিনী একটি যাত্রীবাহী বাস থামায় এবং প্রত্যেক যাত্রীর ধর্ম পরিচয় জানতে চায়। ১২ জন যাত্রীকে তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বাস থেকে নামায়। এরপর হানাদাররা রাস্তার পূর্ব পাশে বর্তমানে পুলিশ সেন্টারের প্রধান গেট ও সড়ক বরাবর তাদেরকে হাঁটিয়ে নিয়ে নসুখান ইটভাটার মধ্যে একটি গর্তের পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার তিনদিন পর লিয়াকত আলী বেগ, তার চাচা আকবর আলী বেগ এবং বেগবাড়ির গৃহশিক্ষক কেশবপুরের নজির ফকির ঐ স্থানে একটি গর্ত খুঁড়ে নিহতদের গণকবর দেয়। হতভাগ্য লোকগুলো বাসের যাত্রী হওয়ায় তাদের কোনো পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। ঘটনাস্থলে পরবর্তীতে গণহত্যা ও গণকবর স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে।
২৯শে মে নসুখান ইটভাটায় আরেকটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এপ্রিল মাসে খুলনার বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু হলে হাজার-হাজার হিন্দু মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে থাকে। দিঘলিয়ার হিন্দু অধ্যুষিত দেয়াড়া গ্রামের বাসিন্দারাও ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভারতে যাবার পথঘাট তাদের জানা ছিল না।
তাই তারা এখানে বসবাসরত মুকরাম মেট নামে একজন হিন্দু বিহারির সঙ্গে প্রচুর টাকার বিনিময়ে ভারতে পৌঁছে দেবার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। মুকরাম মেট ছিল ভারতীয়। সে দেয়াড়া গ্রামে অবস্থিত ‘রশিদ ব্রাদার্স’ নামক একটি পাট কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে দীর্ঘদিন যাবৎ এ এলাকায় বসবাস করছিল। ফলে বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ভারত গমনেচ্ছু স্থানীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করে তার সকল প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয় এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে দশটি পরিবারের সদস্যরা দৌলতপুরের মহসিন মোড়ে এসে পৌঁছায়। কিন্তু মুকরাম মেট বিশ্বাসঘাতকতা করে দৌলতপুরের কুখ্যাত বিহারি ইলিয়াস খানের পুত্র ইসমাইল খানের মাধ্যমে দৌলতপুরে অবস্থানরত পাকসেনাদের হাতে তাদের ধরিয়ে দেয়। পরিতোষ নামে একজনসহ কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অন্যরা পাকসেনাদের হাতে বন্দি হয়। তাদের মধ্যে ১৪ জন পুরুষের নাম জানা গেলেও মহিলাদের সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি।
ধৃত ১৪ জনকে প্রথমে দৌলতপুরে অবস্থিত আবুল কাসেমের গোডাউনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাতে তাদের নসুখান ইটভাটায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। নারীদের গোডাউনের ভেতরে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়। হতভাগ্য যেসব ব্যক্তি গণহত্যার শিকার হন, তারা হলেন- অধীর কুমার দাস, অরবিন্দ কুমার দাস, দিলীপ কুমার দাস, শেখর কুমার দাস, ঠাকুর পদ দাস, দয়াল কুমার নন্দী, মনোরঞ্জন দাস, কালীপদ দাস, কনক চন্দ্র দাস, মঙ্গল চন্দ্ৰ দাস, রাজেন্দ্র দাস, হরিপদ দাস, সঞ্জয় কুমার দত্ত ও রাধানাথ দাস। উল্লেখ্য, নসুখান ইটভাটাটি বর্তমানে আর নেই। [পারভীন সুলতানা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড