মুক্তিযুদ্ধে নন্দীগ্রাম উপজেলা (বগুড়া)
নন্দীগ্রাম উপজেলা (বগুড়া) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি আকবর আলী খান চৌধুরী এমএলএ, থানা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি কে এম মকছেদ আলী, সাধারণ সম্পাদক মরু মণ্ডল এবং আবু বক্কর সিদ্দিক (যুদ্ধকালীন কমান্ডার)-এর নেতৃত্বে নন্দীগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি তৈরি হয়। ২৬শে মার্চ নন্দীগ্রাম থানাসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। উপজেলার ভাটগ্রাম ইউনিয়নের হাটকড়ই হাড়সা পুকুরপাড়ে আবু বক্কর সিদ্দিক, বদিউজ্জামান মন্টু (যুদ্ধকালীন ডেপুটি কমান্ডার), সিরাজুল ইসলাম (ডেপুটি কমান্ডার) এবং আজিজুল হক পুটু (গ্রুপ কমান্ডার) ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুনস্থ টান্ডুয়া ট্রেনিং সেন্টার থেকে মুজিব বাহিনী-র (বিএলএফ) ৪৫ দিনের উচ্চ প্রশিক্ষণ নেন। তাঁদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকৌশল নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাঁরা বগুড়ার পশ্চিম অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর প্রধান এ বি এম শাহজাহানের নির্দেশে নন্দীগ্রাম থানার দাড়িয়াপুর, আমড়াগোহাইল, হাটকড়ই ও দলগাছায় অবস্থান নেন এবং বিভিন্ন গ্রামের ৪২ জন যুবককে ১৯ দিনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। এছাড়া দমদমা, বাঁশো এবং ভাটরা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
নন্দীগ্রাম উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আবু বক্কর সিদ্দিক, ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন বদিউজ্জামান মন্টু ও সিরাজুল ইসলাম এবং গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আজিজুল হক পুটু, দেলোয়ার হোসেন, মোজাম্মেল হক, আলতাব হোসেন, মেহের আলী ও আব্দুস সামাদ।
৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী নন্দীগ্রাম উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। এরপর তারা নন্দীগ্রাম থানা, রণবাঘা ও মনসুর হোসেন ডিগ্রি কলেজ মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য আব্দুর রহমানকে (কাথম) সভাপতি এবং হাতেম আলীকে (পাকুরিয়া পাড়া) সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। খলিলুর রহমানকে (মাজগ্রাম) সভাপতি এবং খোরশেদ আলমকে (দিঘীরপাড়) সাধারণ সম্পাদক করে আলশামস বাহিনী গঠন করা হয়। সমগ্র উপজেলাজুড়ে এদের নেটওয়ার্ক ছিল। এরা পাকবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর পৌঁছে দিত এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর দেখিয়ে দেয়ার কাজ করত।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হাসেন আলী (নামুইট), সোবেতুল্ল্যাহ (বেলঘরিয়া), নারায়ণ চন্দ্র (গুন্দইল) ও নন্দনাল (দাশগ্রাম)-এর বাড়িতে লুণ্ঠন চালায়। তারা জসিমুদ্দিন (হাটকড়ই) ও সাবেদের বাড়ি (নন্দীগ্রাম সদর) এবং মনসুর হোসেন ডিগ্রি কলেজের কক্ষে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া কাথম গ্রামের ডা. অরুণ চন্দ্রের বাড়িতে নারীনির্যাতন চালায়। পাকবাহিনী চাকলমা গ্রামের আকরাম হোসেনকে না পেয়ে তার পিতা করমতুল্ল্যাকে তুলে নিয়ে মনসুর হোসেন ডিগ্রি কলেজে আটকে রাখে।
পরবর্তীতে আকরাম হোসেন পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমৰ্পণ করলে তারা তার পিতাকে ছেড়ে দেয়। এরপর পাকবাহিনী আকরাম হোসেনকে হত্যা করে, কিন্তু তার মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফেরত দেয়নি। ৪ঠা এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে পাকবাহিনী ভাটরা ইউনিয়নের গ্রামের হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ চালায় এবং দুখপুকুর পাড়ের পশ্চিম পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে কবিরাজ প্রাণবন্ধু চন্দ্র, মণীন্দ্ৰ চন্দ্র সাহাসহ অনেককে গুলি করে হত্যা করে। এটি -দুখপুকুরপাড় গণহত্যা নামে পরিচিত। এরপর তারা রাত সাড়ে ৩টার দিকে হাটকড়ই হিন্দুপাড়ায় হানা দিয়ে সেখান থেকে সুরেশ চন্দ্র, ব্রজেশ্বর চন্দ্রসহ আরো কয়েকজনকে ধরে এনে হাটকড়ই হাইস্কুল মাঠে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড হাটকড়ই গণহত্যা নামে পরিচিত।
৯ই এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা নন্দীগ্রাম থানা অপারেশন – পরিচালনা করেন। এ-সময় থানায় অবস্থানরত রাজাকার ও পুলিশবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজাকার ও পুলিশবাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে, মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করেন এবং থানার সকল অস্ত্র তাঁদের আয়ত্তে আসে। ১১ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য বগুড়া সেনানিবাস থেকে নন্দীগ্রামে প্রবেশ করে। এ-সময় বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) কমান্ডার আবু বক্কর সিদ্দিকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মণ্ডলপুকুর ও কৈগাড়ী নামক স্থানে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়, যা মণ্ডলপুকুর যুদ্ধ ও কৈগাড়ী যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে হানাদার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা পুন্ন খান নামে পাকবাহিনীর একজন সৈনিককে আটক করেন এবং পরে তাকে বগুড়ায় মিত্রবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করেন। ১২ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সদস্যরা দুটি জিপ গাড়ি নিয়ে আবার থানায় প্রবেশের চেষ্টা করে। এ-সময় মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করলে তারা পালিয়ে যায় এবং পালাবার সময় ডাকনিতলা নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়, যা ডাকনিতলা যুদ্ধ- নামে পরিচিত। অবশেষে রণবাঘা নামক স্থানে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর দুটি যুদ্ধবিমানের আক্রমণে তারা পর্যুদস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। ১৩ই ডিসেম্বর কমান্ডার আবু বক্কর সিদ্দিক পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং ঐদিনই নন্দীগ্রাম থানা হানাদারমুক্ত হয়।
নন্দীগ্রাম উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আকরাম হোসেন (পিতা করমুতুল্ল্যাহ সরকার, চাকলমা), আব্দুল ওহেদ (পিতা বাসতুল্যা, বাদলাশন), জসিমুদ্দিন আহম্মেদ (পিতা লতিবুল্ল্যা, হাটকড়ই), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা লতিবুল্ল্যা, হাটকড়ই), আব্দুর রশিদ (পিতা লতিবুল্ল্যা, হাটকড়ই), মরু মণ্ডল (পিতা কানু মণ্ডল, ভাটরা), আব্দুল মজিদ (পিতা আব্দুস সোবাহান, ভাটরা), মোফাজ্জল (পিতা আব্দুল গফুর, নন্দীগ্রাম) এবং মফিজ উদ্দিন (পিতা তালেব আলী, মুরাদপুর)।
এ উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আকরামের নামে শহীদ আকরাম সড়ক ও শহীদ আকরাম স্মৃতি সংঘ (ক্লাব) রয়েছে। [মো. ফিরোজ কামাল ফারুক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড