মুক্তিযুদ্ধে ধোবাউড়া উপজেলা (ময়মনসিংহ)
ধোবাউড়া উপজেলা (ময়মনসিংহ) ১৯৭১ সালে দুর্গাপুর থানার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন ছিল। দুর্গাপুর ও হালুয়াঘাট থানার মাধ্যমে এ এলাকার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের পটভূমিতে ছাত্রসমাজের মাধ্যমে এ অঞ্চলে স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনে ছাত্র ও তরুণ সমাজ মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ হয়। দুর্গাপুর থানার রাজনৈতিক নেতা মো. মহীউদ্দিন, জালাল উদ্দিন তালুকদার, হালুয়াঘাটের জনপ্রতিনিধি মো. কুদরত উল্লাহ মণ্ডল এমপিএ এবং এলাকার আওয়ামী লীগ- নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বাঘমারা, শিববাড়ি, মহেন্দ্রগঞ্জ ও ডালু ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঘোষগাঁও ইউনিয়নের জিগাতলায় পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প স্থাপিত হয়। মে-জুন মাসে ধোবাউড়া উচ্চ বিদ্যালয়, কালিকাবাড়ী, পোড়াকান্দুলিয়া, গোয়াতলা এসব স্থানেও পাকবাহিনী কয়েকটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। তবে এসব ক্যাম্পে তারা অল্প সময়ের জন্য অবস্থান করত। রাজাকাররাই প্রধানত এসব ক্যাম্পে থাকত। পার্শ্ববর্তী হালুয়াঘাট, দুর্গাপুর, পূর্বধলা ও ফুলপুর থেকে পাকসেনারা এসে বিভিন্ন সময়ে এ উপজেলায় অভিযান চালাত।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা ধোবাউড়া উপজেলায় ৩টি গণহত্যা চালায়। সেগুলো হলো- তারাইকান্দি গণহত্যা, চারুয়াপাড়া গণহত্যা ও জিগাতলা গণহত্যা। সেপ্টেম্বর মাসে তারাইকান্দি গণহত্যায় ৪৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হয়। জুন মাসে চারুয়াপাড়া গণহত্যায় ২৭ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। জিগাতলা গণহত্যা সংঘটিত হয় মে মাসে। এতে এ দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। উপজেলার সীমান্তবর্তী দিঘলবাগ গ্রামে নেতাই নদীর তীরে একটি গণকবর রয়েছে। এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে একত্রে কবর দেয়া হয়। তবে গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয়নি।
ধোবাউড়া উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি যুদ্ধ হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা দুটি অপারেশন পরিচালনা করেন। সেগুলো হলো- জিগাতলা যুদ্ধ, গোয়াতলা যুদ্ধ, রণসিংহপুর যুদ্ধ, কালিকাবাড়ী পাকক্যাম্প অপারেশন এবং পোড়াকান্দুলিয়া রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন। জিগাতলা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯শে জুলাই। এতে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। গোয়াতলা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১০ই সেপ্টেম্বর। এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর পাকবাহিনী গোয়াতলা বাজারে আগুন দেয় এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। রণসিংহপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহে কোম্পানি কমান্ডার স্নিকবিন্দু বাউল, আব্দুর রহমান ও দীপক সাংমার নেতৃত্বে। এদিন রণসিংহপুর গ্রামের আকন্দ বাড়িতে পাকসেনাদের আক্রমণের খবর পেয়ে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনীর মেজর সুলতান আহত হয় এবং এক পর্যায়ে পাকবাহিনী পিছু হটে। কালিকাবাড়ী পাকক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় কমান্ডার ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে। এতে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয় এবং পরে তারা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ৩৭টি মার্ক ফোর রাইফেল, ৭টি মর্টারের গোলা, ১টি গ্রেনেড, ১টি বাইনোকুলার ও বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। এ অপারেশনে হারুন-অর-রশিদ নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পোড়াকান্দুলিয়া রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে। গৌরাঙ্গ সাহার বাড়িতে অবস্থিত এ ক্যাম্প অপারেশনে রাজাকাররা পরাজিত হয় এবং তাদের কমান্ডার ইছমামুদ ধরা পড়ে। ৮ই ডিসেম্বর ধোবাউড়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ধোবাউড়া উজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুস সালাম (বল্লভপুর; ২রা সেপ্টেম্বর জিগাতলা পাকক্যাম্প যুদ্ধে শহীদ ও সীমান্তবর্তী ঘিলাগড়ায় সমাহিত) এবং সাইদুর রহমান (উত্তর শালকোণা; পুলিশ সদস্য, চট্টগ্রামে এক প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ)। এছাড়াও পূর্বধলা উপজেলার দুজন মুক্তিযোদ্ধা গোকুল দেবনাথ ও ফেরদৌস জিগাতলা পাকক্যাম্প যুদ্ধে শহীদ হন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস সালামের নামে ধোবাউড়া বাজারের ব্রিজের পূর্বপাশের মোড় থেকে কলসিন্দুর অভিমুখী রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ আব্দুস সালাম সড়ক’। [সলিল দত্ত]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড