ধূলদিয়া রেলসেতু অপারেশন (কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ)
ধূলদিয়া রেলসেতু অপারেশন (কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ) পরিচালিত হয় ১২ই অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার ধূলদিয়া এলাকায়। এর কিছুদিন পূর্বে এ উপজেলারই গচিহাটা রেলস্টেশনে মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটি সফল অপারেশন পরিচালিত করেন। সে অপারেশনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং কয়েকদিন পরে রাজাকারদের স্বপক্ষ ত্যাগ পাকসেনাদের দুঃশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। তারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কৌশল নির্ধারণের জন্য অল্পসংখ্যক সেনাসদস্য, প্যারা-মিলিশিয়া ও কয়েকজন রাজাকারকে ধূলদিয়া রেলসেতু পাহারায় রেখে কিশোরগঞ্জ সদর দফতরে চলে যায়। এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা সেতু অপারেশনের পরিকল্পনা করেন।
আব্দুর রহিম ও আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক, মাইন ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে ভিটিপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা আমিন মাস্টারের বাড়ি ও বনগ্রাম হাইস্কুলে অবস্থান নেন। এ অপারেশনে হাবিবুল্লাহ খান, আব্দুস সাত্তার (দশপাখি), শাহাবুদ্দিন খান (ভিটিপাড়া) এবং আনিসুজ্জামান খোকন (গচিহাটা)-এর দল অংশ নেয়। হাবিবুল্লাহ খান ও আব্দুস সাত্তারের দলে ছিলেন আব্দুর রহিম (বৈজ্ঞানিক রহিম ওরফে আবিদ আনোয়ার, চর আলগী), তুলসী কান্তি রাউত (চানপুর), মতিউর রহমান খান (ফুলদী), ছিদ্দিক হোসেন ছিদ্দু (বাগরাইট), আফাজউদ্দিন (জালালপুর), শামসুল ইসলাম তুলা (জালালপুর), আব্দুল হেকিম (জালালপুর), আব্দুল কাদির (লোহাজুড়ি), লিয়াকত (লোহাজুড়ি), খুরশিদ (লোহাজুড়ি), মুসলিম (লোহাজুড়ি), মফিজ (লোহাজুড়ি), হানিফ (করগাঁও), জিল্লুর রহমান (করগাঁও) প্রমুখ। ১১নং সেক্টরের অন্যতন কমান্ডার হাবিবুল্লাহ খানের দলে ছিলেন শাহজাহান (বাঘবেড়), মানিকউদ্দিন (চানপুর), নিবেদন কান্তি রাউত (চানপুর), বিজন রায় (চানপুর), আব্দুল মান্নান খান (চানপুর) প্রমুখ। শাহাবুদ্দিন খানের দলে ছিলেন বনগ্রামের আমিনুল, মঞ্জিল, আমিনুল হক মাস্টার প্রমুখ। আনিসুজ্জামান খোকনের দলে ছিলেন আব্দুস সালাম ওরফে দুলাল কমান্ডার (বেতাল) প্রমুখ।
১২ই অক্টোবর সকাল ১০টায় সেতু প্রহরায় নিয়োজিত স্বল্পসংখ্যক পাকসেনা, প্যারা-মিলিশিয়া ও রাজাকারদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ চালান। শত্রুপক্ষ কয়েকদিন আগের পরাজয়ের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে কোনোরূপ প্রতিরোধের চেষ্টা না করেই ধূলদিয়া বাজার হয়ে উত্তর দিকে পালিয়ে যায়। তাদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে এ রাস্তা উন্মুক্ত রেখেছিলেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল রেলসেতু বিধ্বস্ত করে পাকসেনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া।
ধূলদিয়া সেতুটি মৃতপ্ৰায় একটি ছোট নদী সিংগুয়ার ওপর অবস্থিত ছিল। এর দুপাশে অনেকদূর পর্যন্ত কাদা-জল ও কচুরিপানায় পূর্ণ একটি বিল ছিল। এরূপ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত সেতুটি বিধ্বস্ত করে নিরাপদে সরে যাওয়ার মতো সুযোগ ছিল না। এ বিষয়টি জানা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিস্ফোরক, জিলাটিন, প্রাইমার কর্ড, ফিউজ, ডেটোনেটর প্রভৃতিসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা যথাস্থানে অবস্থান নেন। তাঁদের কভার দেয়ার জন্য বিভিন্ন দলভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা সেতু থেকে কিছুটা দূরে পাকসেনাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চারদিকে অবস্থান নেন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কাদা-জলপূর্ণ বোরো জমিতে সশস্ত্র এম্বুশ করেন। অপারেশনের মূল দায়িত্বে ছিলেন আব্দুর রহিম। তিনি বিস্ফোরক বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। সেতুটির দুদিকে প্রায় এক মাইল দূরত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল পাঠানো হয়। তাঁরা সেতুতে এন্টিট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে শত্রুসৈন্যবাহী ট্রেনের অপেক্ষায় থাকেন। আমিন মাস্টারের নেতৃত্বে আরো দুটি দল রেলের টেলিফোন লাইন কেটে পূর্বোক্ত দুদলের সঙ্গে যোগ দেয়। হাবিবুল্লাহ খান রেলের ওপর দাঁড়িয়ে কাপড় উড়িয়ে আব্দুর রহিমকে সংকেত দেন। সংকেত পেয়েই তিনি এবং তাঁর সহযোগী শাহাবুদ্দিন খান, তুলসী কান্তি রাউত ও জজ মিয়া আনুষঙ্গিক জিনিসসহ বিস্ফোরক নিয়ে ছোট নৌকাযোগে লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে যান। হঠাৎ তাঁরা অনাকাঙ্ক্ষিত এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। তাঁরা আসছিলেন উত্তর দিক থেকে। আর ওদিকেই জলা এলাকার পূর্ব পাশের কাঁচা রাস্তা ধরে হানাদাররা পালাচ্ছিল। তারা গেরিলাদের নৌকা লক্ষ করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা পানিতে নেমে নৌকার আড়ালে থেকে সেতুর দিকে অগ্রসর হন। যথাস্থানে পৌঁছে রহিম ও তুলসী কান্তি রাউত বিস্ফোরকভর্তি টিনগুলোকে সেতুর পিলারের সঙ্গে বাঁধেন। রেলপাতের ওপর কাটিং চার্জ ও নিচে লিফটিং চার্জ বসানো হয় এবং প্রাইমার কর্ড দিয়ে এগুলোর সঙ্গে বিস্ফোরকপূর্ণ টিনের সংযোগ দেয়া হয়। হাবিবুল্লাহ খান, আব্দুস সাত্তার ও আব্দুর রশিদ তাঁদের দল নিয়ে সেতুর দুদিকে সরে গিয়ে ফিউজে আগুন লাগান। এর দুমিনিটের মাথায় দুপুর পৌনে বারোটার দিকে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে সেতুটি বিধ্বস্ত হয়।
অপারেশন সফল করে মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে বনগ্রাম হাইস্কুলে অবস্থান নেন। সেতু বিধ্বস্ত হওয়ার পর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দুটি বিমান অকুস্থলের ওপর চক্কর দেয় এবং আশেপাশে এলোপাতাড়িভাবে গোলাবর্ষণ করে। গুরুত্বপূর্ণ এ অপারেশন সফল হওয়ায় কটিয়াদী এলাকা প্রায় মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। কারণ, কিশোরগঞ্জ জেলার সঙ্গে কটিয়াদী থানার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল ধূলদিয়ার এ রেলসেতু। এটি ধ্বংস হওয়ায় এ এলাকায় পাকসেনাদের চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। [মো. রফিকুল হক আখন্দ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড