ধামাই বাগান চা ফ্যাক্টরি আক্রমণ (জুড়ী, মৌলভীবাজার)
ধামাই বাগান চা ফ্যাক্টরি আক্রমণ (জুড়ী, মৌলভীবাজার) কমান্ডার মুহিত ফারুক, আতিক ও মাসুকের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে চা ফ্যাক্টরির মেশিন ঘর চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন। এটি ছিল তাঁদের একটি সফল অভিযান।
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার ধামাই চা বাগানে চা প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি টি-প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ছিল। জুড়ী বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বদিকে এ বাগানের অবস্থান। পাকসেনাদের বড় একটি অংশ এখানে অবস্থান করত। চা-বাগানের ক্লাবে প্রতি শনিবার সারারাত আনন্দ- ফূর্তির আয়োজন করা হতো। পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকর্তারা এ আয়োজনে অংশ নিত। জুনে লাটিটিলা বিওপির যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় এবং জুলাই মাসে দিলখুশ চা-বাগানে পরপর তিনটি আক্রমণ সফল হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা বেশ আক্রমণাত্মক ছিলেন। কিন্তু বারপুঞ্জির তদানীন্তন সাবসেক্টর অধিনায়ক লে. এমদাদের নেতৃত্বে ঝটিকা হামলায় আক্রান্ত হয়ে পাকহানাদাররা পালিয়ে গেলেও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। এতে পাকসেনারা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। নতুনভাবে দল ভারী করে তারা ধামাই চা-বাগানকে অভয়ারণ্যে পরিণত করে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা চা- বাগানের ফ্যাক্টরি উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৪-৫ কিলোমিটার দূরবর্তী কুকিরতল সাবসেক্টর থেকে অপারেশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। জুড়ী বাজারস্থ পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে এ চা-বাগানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো। এছাড়া ৩০-৪০ জন রাজাকারের একটি দল চা-বাগানের ফ্যাক্টরি সর্বক্ষণ পাহারা দিত। পাকসেনাদের একটি টহল দল ফ্যাক্টরির দেয়ালের পশ্চিমমুখী গেইটে অবস্থান করত। মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন যে, শনিবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে রাত ৮টার পর ফ্যাক্টরির আলো বন্ধ রাখা হয়। শনিবারে আলো থাকে এবং পাহারাও। শিথিল হয়। তাই শনিবারই অপারেশনের দিন ঠিক করা হয়। যে-কোনো অবস্থায় রাজাকারদের সাহায্য করার জন্য জুড়ীস্থ পাকসেনারা প্রস্তুত থাকলেও শনিবার আমোদ- প্রমোদে তারা নিমগ্ন থাকে। ফলে শনিবারই আক্রমণের জন্য যথার্থ দিন হিসেবে নির্ধারিত হয়।
গেরিলা কমান্ডার মুহিত ফারুক, আতিক এবং মাসুককে আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। গেরিলা কমান্ডার ফারুক ও মাসুক জুড়ীরই সন্তান। আতিকের বাড়ি বিয়ানীবাজারে। হলেও তিনি জুড়ীর সবকিছু জানতেন। আতিক বিচক্ষণ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। রাত ৯টায় তাঁরা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেন। কিন্তু রাত ১২টার আগে পাকবাহিনীর কর্তকর্তারা মাতাল হবে না বলে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়। এক সময় হামাগুড়ি দিয়ে মুহিত ফারুক সেন্ট্রিকে কাবু করেন। গেরিলাদের হাতে সেন্ট্রি নিহত হয়। আতিক কভার দিতে ব্যস্ত ছিলেন। আর মাসুক ছিলেন ক্রলিং-এ। তাঁরা ভেতরের কাউকে কিছু আঁচ করতে না দিয়ে ফ্যাক্টরিতে ঢুকে তাবুতে ঘুমন্ত অবস্থায় অন্যদের নিরস্ত্র ও বন্দি করতে সক্ষম হন।
দল নিয়ে এগিয়ে আসেন আতিক। সবকিছু তদারক করে ডেটনেটর প্রেস করার জন্য প্রস্তুত হন। একই সঙ্গে মাসুকের দল ফায়ারিং শুরু করে। ডেটোনেটর প্রেস করার সঙ্গে-সঙ্গে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে পুরো ফ্যাক্টরি আগুনের কুণ্ডলীতে পরিণত হয়। মেশিন ঘর গুঁড়িয়ে কংক্রিট ও লোহালক্কড়ের আবর্জনায় রূপান্তরিত হয়। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ কুকিরতল ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে। এ আক্রমণ সফল হওয়ায় গেরিলা যোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। [হাসনাইন সাজ্জাদী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড