ধীতপুর যুদ্ধ (শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ)
ধীতপুর যুদ্ধ (শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৩ই ডিসেম্বর। এতে ৩ জন রাজাকার ও ১ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় ২ জন পাকসেনা ধরা পড়ে এবং গ্রামের লোকদের গণপিটুনিতে নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পলায়নরত ৩ জন রাজাকারকে ধরে তাদের অস্ত্র কেড়ে নেন। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন ইপিআর সদস্য আহত হন। এ-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শাহজাদপুরের পূর্বাঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়।
শাহজাদপুরের জালালপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। রাতে এ ক্যাম্পে খবর আসে যে, টাঙ্গাইল থেকে একদল পাকিস্তানি সেনা এনায়েতপুরের কাছে যমুনা নদী পাড় হয়েছে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুতি নেন। তাঁরা সেখান থেকে রেকি করে শিবপুর যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। সেখানে ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁরা নিজেদের ৩টি গ্রুপে বিভক্ত করেন। সিদ্ধান্ত হয় শিবপুর কালীবাড়ির পাশে গিয়ে একত্রিত হবেন। শিবপুরে গিয়ে তাঁরা খবর পান যে, পাকবাহিনী নদীর ধার দিয়ে নগরবাড়ির দিকে এগুচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঘাটাবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখেন ১০-১৫ ফুট পরপর পাকসেনারা লাইন করে হেঁটে যাচ্ছে। তারা আত্মসমর্পণের জন্য ওয়াপদা বাঁধ দিয়ে হেঁটে রওনা হয়েছিল। তখন পাকসেনাদের কামারখন্দ এবং বেলকুচির মুক্তিযোদ্ধারা ধাওয়া করেন। গুলির শব্দে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা যে যাঁর দল নিয়ে এগিয়ে আসেন। শাহজাদপুরের পূর্ব অঞ্চলে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও ওয়াপদা বাঁধের দিকে আসেন। ৩৫ জনের একটি দল ছিল মোলকান্দিতে। এদলও বাঁধের দিকে আসে। এ-যুদ্ধে পাবনার আমীর হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, ফেরদৌস হোসেন ফুল, আব্দুল হাই, মো. আব্দুস সালাম এবং আব্দুস সাত্তার কুদরতীর দল অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিম দিকের আড়ালে থেকে পাকসেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। তখন শত্রুসেনারা বাঁধের পূর্ব পাশের মাঠে ছিল। তারা ফায়ার করতে-করতে এগিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পেছন থেকে অনুসরণ করেন। কৈজুরি পথাইলা পাড়ার আগে একটি নদীর কাছে তারা অবস্থান নিলে মুক্তিযোদ্ধারা নদীর ওপাড় থেকে গুলি করেন। এভাবে দুই পক্ষের মধ্যে কিছুক্ষণ সামনাসামনি গুলি বিনিময় হয়। ক্ষুধার্ত পাকসেনারা নদী পাড় না হয়ে কৈজুরি বাজারে ঢুকে দোকানপাট ভেঙ্গে বিস্কুট ও অন্যান্য শুকনো খাবার খেতে শুরু করে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা নদী পাড় হয়ে পাথাইলা পাড়ার মধ্য দিয়ে বাজারে ঢুকে তাদের মুখোমুখি হয়ে ব্রাশ ফায়ার করেন। তখন তারা গুলি করতে- করতে দৌড়ে পালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও গুলি করেন। এভাবে বিকেল ৫টার দিকে পাকসেনারা ধীতপুরে পৌঁছে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় ভবনে আশ্রয় নেয়। এ খবর পেয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসেন। তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেন। দক্ষিণ দিকে আমীর হোসেন ও ফেরদৌস হোসেন ফুলের দল, পশ্চিম দিকে আব্দুল হাই এবং আজাদ রহমান শাজাহানের দল এবং উত্তর দিকে ছিলেন অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। সব দলের পেছনে অনেক সাধারণ মানুষ ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। এরপর রাতে আস্তে-আস্তে পাকসেনাদের দিক থেকে গুলি আসা কমে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিও প্রায় শেষ। মুক্তিযোদ্ধারা সারারাত চারদিক ঘিরে থাকেন। ভোরে সেখানে ৩ জন রাজাকার ও ১ জন পাকসেনার লাশ পাওয়া যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় ২ জন পাকসেনা ধরা পড়ে। বাকিরা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পলায়নরত ৩ জন রাজাকারকে ধরে তাদের অস্ত্র কেড়ে নেন। ধৃত পাকসেনারা গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে নিহত হয়।
ধীতপুর যুদ্ধে বেড়ার আব্দুল খালেক এবং আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাছাড়া ৪ জন ইপিআর সদস্য আহত হন। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে শাহজাদপুরের পূর্বাঞ্চল হানাদারমুক্ত হয়। শাহাজাদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল খালেক-এর সমাধি রয়েছে। [মাহফুজা হিলালী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড