You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ধর্মপাশা উপজেলা (সুনামগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ধর্মপাশা উপজেলা (সুনামগঞ্জ)

ধর্মপাশা উপজেলা (সুনামগঞ্জ) হাওড়বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলার পশ্চিম-উত্তর সীমান্তে অবস্থিত। ১৯৭০ সালের ১০ই অক্টোবর নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ধর্মপাশায় আসেন। হাজার-হাজার জনতার উপস্থিতিতে তিনি ধর্মপাশা জনতা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ভাষণ দেন। তাঁর আগমন ও ভাষণে হাওড় অঞ্চলে নৌকার পক্ষে ব্যাপক সাড়া জাগে। নির্বাচনের পর বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দেয়ায় সাড়াদেশের মতো ধর্মপাশায়ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চে উত্তাল সারা দেশের মতো সীমান্তবর্তী গারোপাহাড়, নদী আর হাওড় বেষ্টিত উপজেলা ধর্মপাশার সদর ও গ্রামগুলোতেও আন্দোলনের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে দিকনির্দেশনা পেয়ে ধর্মপাশা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক প্রস্তুতি শুরু করেন। আব্দুল হাকিম চৌধুরী এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা চাঁন মিয়া, হাবিবুর রহমান ওরফে জ্যোতি মিয়া, আক্কাছ উদ্দিন তালুকদার, সাইদুর রহমান চৌধুরী, মনি বাবু, খোকন পুরকায়স্থ ও কালা মিয়ার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটির ধর্মপাশা শাখা গঠন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর সম্ভাব্য যুদ্ধের আভাস পেয়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আব্দুল আহাদ ডামি রাইফেল ও দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহ করে এলাকার ছাত্র-যুবকদের নিয়ে স্থানীয় জনতা হাইস্কুল মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরে ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে পাকবাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পেয়ে বাঙালি ইপিআর সদস্য, ধর্মপাশা সীমান্ত ফাঁড়ির স্বাধীনতাকামী পুলিশ সদস্য ও সেনা সদস্যরা হানাদারদের প্রতিরোধ করতে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং এলাকার যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন যুবক্যাম্পে নিয়ে যেতে থাকেন। অপরদিকে সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরের পূর্বাংশের শেষ প্রান্তে ধর্মপাশা থানার অবস্থান। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী মহেষখলা এলাকাটি মুক্তাঞ্চল হওয়ায় এলাকার যুবকরা সহজেই ভারতে প্রবেশ করে মহেষখলা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। পরে উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য সেখান থেকে তাঁদের তুরাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মো. রুহুল আমীন ছিল ধর্মপাশা জনতা হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। তিনি ছাত্রলীগ-এর সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সে-সময় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতেই সে অংশগ্রহণ করে এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি সঙ্গী সিদ্দিকুর রহমানকে নিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেষখলা রিক্রুটিং সেন্টারে যায়। পরে তুরা ট্রেনিং সেন্টারে এক মাস প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল খালেকের অধীনে সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বিজয়পুর, রংরাপাড়া এবং ধর্মপাশা যুদ্ধে সে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ধর্মপাশার অপর মুক্তিযোদ্ধা মো. নূর হুসেন ৩০শে জুলাই সঙ্গী মতিউর রহমানকে নিয়ে মহেষখলা যুবক্যাম্পে যান। পরে তাঁদের ঢালু রিক্রুটিং ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ভারতের তুরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রথমে তিনি মেডিক্যাল টিমের প্রশিক্ষণ নেন। পরে সেখানে থেকে তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে কোম্পনি কমান্ডার ইসলাম উদ্দিন কালা মিয়ার কোম্পানিভুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি বিজয়পুর, রংরাপাড়া, বিরিশিরি ও ধর্মপাশা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ধর্মপাশা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকগণ ছিলেন আব্দুল হাকিম চৌধুরী এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা চাঁন মিয়া, হাবিবুর রহমান ওরফে জ্যোতি মিয়া, আক্কাছ উদ্দিন তালুকদার, সাইদুর রহমান চৌধুরী, মনি বাবু, খোকন পুরকায়স্থ, কালা মিয়া প্রমুখ। আর কমান্ডার ছিলেন আব্দুল খালেক (কোম্পানি কমান্ডার), ইসলাম উদ্দিন কালা মিয়া (কোম্পনি কমান্ডার) ও মো. রুহুল আমীন।
ধর্মপাশা হাওড় অধ্যুষিত একটি এলাকা। এটি সুনামগঞ্জ মহকুমাধীন হলেও ভৌগোলিক কারণে এখানকার যোগাযোগ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থানার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণের খবর ধর্মপাশায় পৌঁছলে এখানে থমথমে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ তখন ধর্মপাশা থানার ওসি ছিল নূরুল ইসলাম। সে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগে গাবি গ্রামের কলেজ ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র-যুবককে ধরে থানায় নিয়ে আটকে রাখে। তারা মোহনগঞ্জ কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিল।
পরে ওসি তাদের দেশ ত্যাগের শর্তে ছেড়ে দেয়। এপ্রিল মাসের শেষদিকে আব্দুল হাকিম চৌধুরী এমপিএ-র নির্দেশে সংগ্রাম কমিটির সদস্য চাঁন মিয়া, কালা মিয়া, দারোগ আলী, আনোয়ার হোসেন ও মিরাজ আলীর নেতৃত্বে ধর্মপাশা থানার অস্ত্র লুট করার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁরা ৩৫টি রাইফেলসহ থানার ওসি নূরুল ইসলামকে ধরে মহেষখলা ক্যাম্পে নিয়ে যান। ৩০শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরে প্রবেশ করে মোহনগঞ্জ থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এর দুদিন পর ২রা মে তারা নদীপথে এসে ধর্মপাশায় প্রবেশ করে এবং ধর্মপাশা থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
ধর্মপাশা উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল ছিল পিডিপি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী। সংগঠন হিসেবে ছিল শান্তি রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী। স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিরা হলো মিসবাউদ্দৌজা রেজা (সেলবরস), সৈয়দ রফিকুল হক (সেলবরস), আবুল হোসেন চৌধুরী (জয়শ্রী), আব্দুল হেকিম (পাইকারহাটি), আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী ওরফে ছফেদ আলী (দশদড়ি), আক্কল আলী (বংশীকোণ্ডা), মাজহারুল ইসলাম (রাজাপুর), গিয়াস উদ্দিন তালুকদার (সৈয়দপুর), ফজলুল হক (রাজনগর), জাকারিয়া চৌধুরী (সেলবরস), মহর আলী (হরিদাকান্দা), আরফান আলী (দুধবহর) প্রমুখ। এরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করত। ২রা মে পাকিস্তানি বাহিনী ধর্মপাশা সদরে প্রবেশ করেই দালালদের সহযোগিতায় স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের বাড়িঘর দখল, অর্থসম্পদ লুট ও হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে। প্রথম দিনেই তারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা আব্দুল হাকিম চৌধুরী এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান ওরফে জ্যোতি মিয়া ও শামছ উদ্দিনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পাকিস্তানি বাহিনী শামছ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এ-সময় একই গ্রামের ধানাই নামে এক ব্যক্তিকেও তারা হত্যা করে।
ধর্মপাশা থানা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য থানার চারপাশে বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চ খুঁড়ে মুজাহিদ ও রাজাকার বাহিনী সার্বক্ষণিক পাহারা দিত। এ-সময় ছাতক ও সুনামগঞ্জ থেকে সুরমা নদীতে পাকিস্তানি গানবোট টহল দিত। স্থানীয় সার্বিক অবস্থা এবং মুজাহিদ ও রাজাকার বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে ৯ই অক্টোবর সন্ধ্যার পর তিন কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ধর্মপাশা থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনটি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান নিজে, সুবেদার মুসলেহ উদ্দিন ও ইপআির-এর নায়েক আবদুর রহমান। ওয়ারলেসের মাধ্যমে তিনটি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান দুটি কোম্পানিকে তিন ভাগে ভাগ করে তিনদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সন্ধ্যার পরপর রাজাকার ও মুজাহিদরা ট্রেঞ্চে অবস্থান গ্রহণের পূর্বেই তিনদিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হয়। হঠাৎ আক্রমণে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মর্টারের গোলা সরাসরি থানার ওপর গিয়ে পড়ে। বড় ধরনের বিপর্যয়ের ভয়ে রাজাকার ও মুজাহিদরা রাতের অন্ধকারে পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী থানা দখলের পর বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজন শত্রুসৈন্যের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ-সময় বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন (দেওশ্রী, আটপাড়া, নেত্রকোণা) ও আব্দুল হাই শহীদ হন। ৮ই ডিসেম্বর ধর্মপাশা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন আব্দুস ছালাম (সরিষাকান্দা ইসলামপুর; জামালগঞ্জ যুদ্ধে শহীদ) ও আব্দুল হাই (৯ই অক্টোবর ধর্মপাশা যুদ্ধে শহীদ)।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্মারকগুলো হলো মহেষখলা মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ, আব্দুল হাকিম চৌধুরী স্মৃতিফলক ও শহীদ আব্দুল হাই সড়ক। এছাড়া সেলবরস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মো. নূর হুসেন ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। [আলী আহাম্মদ খান আইয়োব ও জুলফিকার আলী শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড