মুক্তিযুদ্ধে দৌলতপুর উপজেলা (কুষ্টিয়া)
দৌলতপুর উপজেলা (কুষ্টিয়া) কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে এখানকার জনগণ খুবই উদ্বুদ্ধ হয়। সমগ্র দেশের ন্যায় তারাও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী মো. আজিজুর রহমান আক্কাস এমএনএ, মো. জহুরুল ইসলাম রাজা এমপিএ, মো. নিজাম উদ্দীন প্রমুখের নেতৃত্বে তারা সংগঠিত হয়। ১১ই মার্চ উপজেলার মহিষকুণ্ডি মাঠে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ-এর নেতৃত্বে সহাস্রাধিক জনতার এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে অংশগ্রহণকারী সকলে হাতে লাঠি ও স্থানীয় অস্ত্র নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য শপথ নেন। এ সমাবেশে মো. আজিজুর রহমান আক্কাস এমএনএ, মো. জহুরুল ইসলাম রাজা এমপিএ, ছাত্রনেতা আ স ম রব, রফিকুল আলম, আবদুল কাদের মাস্টার প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর দৌলতপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল দলসমূহের নেতা- কর্মীরা সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন। জয়পুর প্রাইমারি স্কুল এবং মাধাপুর ক্লাবে স্থানীয় কয়েকজন যুবক লাঠিসোঁটা দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন। সেনাসদস্য আনসার আলী, আনসার সদস্য নুরুল ইসলাম এবং আজিম উদ্দিন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ২১ থেকে ২২ দিন এখানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সহজেই এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের শিকারপুর ইয়ুথ ক্যাম্প, কড়ইগাছি, ব্যাতাই, করিমপুর, জমশেদপুর, বিহার, কৃষ্ণনগর, রামপুর হাট, জলঢাকা, তেলঢাকা, চাকুলিয়া ও বীরভূম ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মো. নজরুল ইসলাম গেরিলা, আবদুল জলিল, মুনসুর রহমান, আবদুস সামাদ, আবুল কাশেম-১, আবুল কাশেম-২, আবদুল হান্নান, আবদুল বারী, আজিমুদ্দিন, শমসের আলী প্রমুখসহ ১২৬১ জন মুক্তিযোদ্ধা বীরভূম জেলার রামপুরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
দৌলতপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এপ্রিলের ১ম সপ্তাহে করিমপুর ক্যাম্পে এবং এর ১৫ দিন পর শিকারপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর বিহারের চাকুলিয়া ও বীরভূমের রামপুর হাটে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। রামপুর হাট ক্যাম্পে মো. মহিউদ্দিন মোল্লা কমান্ডার এবং মো. সাহেব আলী ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
চারুলিয়া বীরভূম ট্রেনিং সেন্টারে কমান্ডার ছিলেন মো. হামিদুল ইসলাম এবং ডেপুটি কমান্ডারের ছিলেন মো. মাফিকুজ্জামান খান।
দৌলতপুর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য সংগঠকরা হলেন- মো. আজিজুর রহমান আক্কাস এমএনএ (বাহিরমাদি), মো. জহুরুল ইসলাম রাজা এমপিএ (ভেড়ামারা), মো. রফিকুল আলম (কাপুড়পুড়া), মো. আব্দুল জব্বার (চিলমারী), প্রফেসর মো. আব্দুল্লাহ (ফিলিপনগর), মো. নিজামউদ্দীন (গবরগাড়া), মো. নজরুল ইসলাম (মাদাপুর), মো. নকিম উদ্দীন বিশ্বাস (মুসলিমনগর), মো. আবুল কাশেম সরকার (প্রাগপুর), মো. আব্দুল কাদের মাস্টার (মহিষকুণ্ডি), শামছুদ্দীন মালিথা (মথুরাপুর), মো. নুরুল হুদা পালু (নজিবপুর), মো. মজিবুল হক মাঙ্গন, আজিজুল হক (মহিষকুণ্ডি), মোয়াজ্জেম হোসেন (খলিষাকুণ্ডি), মো. মাফিকুজ্জামান (বোয়ালিয়া), মো. আব্দুল লতিফ (বোয়ালিয়া), মো. আব্দুর রাজ্জাক (দাড়েরপাড়া), জান মোহাম্মদ (দাড়েরপাড়া), মো. আফতব খান (শেরপুর), মো. আব্দুল জলিল (পোড়া সলুয়া), মো. আব্দুল মালেক (চিলমারী), মো. আবুল কাশেম (হোগলবাড়িয়া), মো. আলতাফ হোসেন (রামকৃষ্ণপুর), মো. আব্দুস সামাদ (রামকৃষ্ণপুর), মো. আবুল কাশেম (রামকৃষ্ণপুর), মো. আব্দুল মজিদ (রামকৃষ্ণপুর), মো. হযরত আলী (মথুরাপুর), মো. আব্দুর রহমান (মথুরাপুর), মো. আব্দুর রাজ্জাক (দৌলতপুর), মো. আজগর আলী, মো. শাহ আলম, মো. জহুরুল ইসলাম, মো. শামছুল হক, মো. হামিদুল হক, মো. মোকাদ্দেস হোসেন এবং মো. মহসিন আলী (আড়িয়া)। দৌলতপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মো. নজরুল ইসলাম গেরিলা (পিতা লোকমান হোসেন, মাধাপুর, প্রাগপুর; তখন তিনি মেহেরপুর কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত)। উপজেলার বিভিন্ন যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে চিলমারী ইউনিয়নে আব্দুল মালেক, জব্বার দেওয়ান ও মোজাম্মেল হক; প্রাগপুর ইউনিয়নে হাবিলদার মো. আজগর আলী, ইপিআর সদস্য আফিল উদ্দীন, আবুল কাশেম সরকার, আব্দুল কাদের মাস্টার, নকিম উদ্দিন বিশ্বাস, আজিজুল হক এবং এফ কোম্পানির লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর আলম, পিয়ারপুর ইউনিয়নে মো. আব্দুল জলিল ও সেকেন্দার আলী; হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নে শরীফ উদ্দিন চৌধুরী, ফরাতউল্লাহ, আজগর আলী, আফছার উদ্দিন, তোফাজ্জেল হোসেন, উইং কমান্ডার মোবারক হোসেন, প্লাটুন কমান্ডার মো. ইদ্রিস আলী মোল্লা, প্লাটুন কমান্ডার আজগর আলী, আবু তালেব, তফেল উদ্দিন, আবু সিদ্দিক; খলিষাকুণ্ডি ইউনিয়নে মো. মোয়াজ্জেম হোসেন ও ডাক্তার আবুল কাশেম, শাহ আলম ও নূরুল হুদা পালু; দৌলতপুর ইউনিয়নে নিজাম উদ্দীন ও আব্দুল লতিফ; রিফাইতপুর ইউনিয়নে আজিমদ্দিন গাইন ও জনাব আলী মাস্টার; আড়িয়া ইউনিয়নে মোশারফ হোসেন খান ও মোবারক হোসেন মাস্টার; আদাবাড়িয়া ইউনিয়নে আব্দুল মজিদ, হিসাব আলী, ইয়ার আলী, ছানাউল্লাহ; মথুরাপুর ইউনিয়নে খোদাবক্স মণ্ডল, সামছুদ্দিন আহম্মেদ, আবুল হোসেন বিশ্বাস, আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস; বোয়ালিয়া ইউনিয়নে আব্দুল লতিফ, মাফিকুজ্জামান খান, আনছার আলী খান, ইয়াছিন শেখ, আজিম উদ্দিন ও সবুর খান; রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে নাসিরুদ্দিন মাস্টার ও আব্দুস সামাদ ; ফিলিপনগর ইউনিয়নে আকবর সরকার, বুদু সরকার ও শাহজাহান মাস্টার; মিরপুর উইনিয়নে মো. আফতাব খান; মরিচা ইউনিয়নে শিহাব উদ্দিনের নাম উল্লেখযোগ্য। এ উপজেলায় বিএলএফ-এর ৪ জন গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন। তাঁরা হলেন- আবু বকর সিদ্দিক (চকঘোগা), জিয়াউল হক (মৌবাড়িয়া), এডভোকেট রেজাউল করিম (হোসনাবাদ) ও গোলাম কিবরিয়া (বিলগাথুয়া)।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকার ছাত্র-যুবকদের নিয়ে উপজেলার কয়েক জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁরা মহিষকুণ্ডির বাগোয়ানের মাধাপুরে রাস্তা কেটে এবং প্রাগপুর-ভেড়ামারা সড়কের ডাংমারকায় রাস্তা কেটে প্রতিরোধ করেন। এ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. নজরুল ইসলাম গেরিলাসহ অনেকে কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ২৬শে এপ্রিল দৌলতপুর উপজেলায় পাকবাহিনী অনুপ্রবেশ করে এবং উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা উপজেলার ভারত সীমান্ত সংলগ্ন মহিষকুণ্ডি ইপিআর ক্যাম্প দখল করে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। পর্যায়ক্রমে তারা প্রাগপুর ইউনিয়নের প্রাগপুর, মথুরাপুর ইউনিয়নের হোসেনাবাদ, দৌলতপুর থানা, উপজেলা পরিষদ চত্বর, বেজপুর ও দুঃখিপুর, হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের তারাগুনিয়া, আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ডাংমড়কা ও ধর্মদহ, খলিষাকুণ্ডি ইউনিয়নের খলিষাকুণ্ডি ও আড়িয়া ইউনিয়নের বড়গাংদিয়া বাজারে ক্যাম্প স্থাপন করে।
দৌলতপুরে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের পর স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। এসব বাহিনী গঠনে মুসলিম লীগ-এর সদস্যরা মুখ্য ভমিকা পালন করে। হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু বকর এবং আল্লাহর দর্গার কালু বিশ্বাসের নেতৃত্বে দৌলতপুর উপজেলায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এছাড়া শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে মকবুল হোসেন (প্রাগপুর), রিফাজ উদ্দীন (প্রাগপুর), আজির উদ্দীন মোল্লা (চেয়ারম্যান, প্রাগপুর ইউনিয়ন), শেখ আলেক উদ্দীন (সাবেক চেয়ারম্যান, মথুরাপুর ইউনিয়ন), বদর উদ্দীন (মথুরাপুর ইউনিয়ন), আলাউদ্দীন মল্লিক (হোসেনাবাদ), আহসানুল হক মোল্লা (তারাগুনিয়া), আব্দুল কুদ্দুস মিয়া (আল্লারদর্গা), দমছের আলী (আমদহ), হিসাব আলী (হরিণগাছি), আব্দুস সোবহান বিশ্বাস (মিরের পাড়া), আব্দুল গনি বিশ্বাস (খলিষাকুণ্ডি), গোলাম মোস্তফা মাস্টার (কামালপুর, শ্যামপুর), আমিরুল ইসলাম (রামকৃষ্ণপুর), তোফাজ্জেল চেয়ারম্যান (চিলমারী), আব্দুল আওয়াল (বাজুমারা), শামছুল হক মাস্টার (উদয়নগর), মজিবর রহমান (গাছেরদিয়াড়), আবদুল ওহাব সরদার (রিফাতপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
রাজাকার কমান্ডার ফজলু হক সরদার (তারাগুনিয়া) এবং মজিবর রহমান (গাছেরদিয়াড়)-এর নেতৃত্বে উপজেলায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। কমান্ডার মজিবরের নেতৃত্বে রাজাকারদের একটি আলাদা বাহিনী গঠিত হয়। উপজেলার কুখ্যাত রাজাকাররা হলো- আনছার ফরাজি (গাছেরদিয়াড়), আবু খান (রিফাতপুর), আব্দুর রহমান খান (দৌলতপুর), মতিউর রহমান (চক দৌলতপুর), আবুল কাশেম (হোসেনাবাদ), জরাফত আলী মুন্সি (আদাবাড়িয়া), গফুর মোল্লা (মহিষকুণ্ডি), আমির মণ্ডল (মহিষকুণ্ডি), পাচু মোল্লা (গোপালপুর), কাউছার বিশ্বাস (কামালপুর), আব্দুর রব (খলিষাকুণ্ডি), মোজাম্মেল হক (খলিষাকুণ্ডি), খলিল (খলিষাকুণ্ডি), জলিল (খলিষাকুণ্ডি), ডা. ইসমাইল হোসেন (নতুন আমদহ), মো. তালেবুর (নতুন আমদহ), মো. ইউছুফ আলী কালু (নতুন আমদহ), ফজলুল হক (নতুন আমদহ), নুরুজ্জামান (আমদহ), নুয়াব আলী (আমদহ), ছাদেক আলী (আমদহ), তফেল মালিথা (আমদহ), বয়েন মালিথা (আল্লারদর্গা), জমশের আলী (হলুদ বাড়িয়া), করিম (শেরপুর), ফজলে রাব্বি (শেহালা), ছাকিম উদ্দিন (গোয়ালগ্রাম), মুনছের ফরাজি (গাছেরদাইড়), রেজাউল হক (ধর্মদহ), আজিজুল হক (ধর্মদহ), শুকুর মণ্ডল (ধর্মদহ), দিদার (গরুড়া), মুনছুর (গরুড়া), পরিস্কার (গরুড়া), আব্দুল আওয়াল মৌলবী (চিলমারী), মৌলবী মতিউর রহমান (চিলমারী), তোফাজ্জেল মৌলবী (চিলমারী), তমিজ মেম্বর (চিলমারী), জয়নুদ্দিন মাস্টার (চিলমারী), খোরশেদ (গাছেরদিয়াড়), আবু বক্কর (গাছেরদিয়াড়), মজিবর মালিথা (গাছেরদিয়াড়), আহাদ মালিথা (গাছেরদিয়াড়), রেজাউল করিম (গাছেরদিয়াড়), কলিমদ্দিন মালিথা (গাছেরদিয়াড়), মো. সিদ্দিক (গাছেরদিয়াড়), সোবহান মালিথা (গাছেরদিয়াড়), কেরামত দফাদার, মফাজ্জল বিশ্বাস (চরদিয়াড়), নজরুল ইসলাম (গাছেরদিয়াড়), আব্দুর রহমান মোল্লা (বালিরদিয়াড়), ফজলুল হক সরদার (শালিমপুর), আনছার সরদার (শালিমপুর), আবুল কাশেম (হোসেনাবাদ), বদরউদ্দিন (হোসেনাবাদ), শামছুদ্দিন (কৈপাল), টুনা (গাছেরদিয়াড়), তৈয়ব উদ্দীন (দৌলতখালী), মোশারফ হোসেন (দৌলতখালী), মতিউর রহমান (চকদৌলতপুর), নুর মোহাম্মদ শাহ (দৌলতপুর), দৌলত হোসেন জটু (দৌলতখালী), আব্দুর রহমান (দৌলতখালী), আহাম্মদ আলী (দৌলতখালী), মো. আজাহার আলী (বড়গাংদিয়া), মুনা চেয়ারম্যান (আড়িয়া), মফিজ উদ্দিন মুন্সী (ছাতারপাড়া), আহম্মেদ মুক্তার (আড়িয়া), আবুল হাশেম (তালবাড়িয়া), দিদার বক্স (বড়গাংদিয়া), রতন শাহ (লক্ষ্মীপুর), খেয়াল উদ্দিন (খলিষাকুণ্ডি), ভেদু মিস্ত্রী (খলিষাকুণ্ডি), তাছের মিস্ত্রী (খলিষাকুণ্ডি), চটা শীল (খলিষাকুণ্ডি), আব্দুল হান্নান (খলিষাকুণ্ডি), এনামূল হক (গাছেরদিয়াড়), বাছেদ ফরাজি (গাছেরদিয়াড়), আব্দুস সাত্তার (গাছেরদিয়াড়), মুনা (গাছেরদিয়াড়) প্রমুখ। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের গাছেরদিয়াড় টলটলি পাড়ার রাহিলা খাতুনকে ধরে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করে। তারা রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাগজোত গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলামের পিতা ইছার উদ্দিনকে ধরে নিয়ে তাঁর শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে এবং মুন্সিগঞ্জ গ্রামের খাতের মণ্ডলের ছেলে ইছারুদ্দিনকে হাতিশালা মোড়ে (মহিষকুণ্ডি) পুলের নিচে মহিষ চরানো অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট খবর আদা-প্রদানের জন্য আগস্টের শেষদিকে তারা মহিষকুণ্ডির তোফজ্জেল হোসেন তোফা এবং রইসউদ্দিনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা গাছেরদিয়াড় গ্রামের নুরু বিশ্বাস, রব্বানী মোল্লা, লতিফ মোল্লা, অনিল বিশ্বাস, রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাগজোত গ্রামের ইছারউদ্দিন, আবেদ ডাক্তার, গোলজার মণ্ডল, খলিষাকুণ্ডি ইউনিয়নের নজিবপুর গ্রামের আব্দুস সোবহান, খেদালী মণ্ডল, তাইজদ্দিন ও ইসমাইল হোসেনের বাড়ি, মথুরাপুর ইউনিয়নে রইচউদ্দিনের ছেলে আজিমুদ্দিন, তারাগুনিয়া হিসনাপাড়ার নইমুদ্দিনের ছেলে হযরত আলীর বাড়িসহ অনেকের বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এ-সময় মহিষকুণ্ডি, পাকুড়িয়া, মহিষকুণ্ডি মাঠপাড়া, মুসলিম নগর, ভাগজোত, কামালপুর, আড়িয়া ইউনিয়নের বড়গাংদিয়া, রওশনপুর, তালবাড়িয়া ও ইউছুফপুর, খলিষাকুণ্ডি ইউনিয়নের শ্যামনগর, পিপুলবাড়িয়া ও সিলিমপুর গ্রামে আক্রমণ করে শতাধিক ঘরবাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। প্রাগপুর ইউনিয়নের মহিষকুণ্ডির হাসিনা বেগম, মাধাপুরের জাহানারা খাতুনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
পাকবাহিনী দৌলতপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের গোয়ালগ্রাম, প্রাগপুর ইউনিয়নের প্রাগপুর, মথুরাপুর ইউনিয়নের হোসেনাবাদ, খলিষাকুণ্ডি ইউনিয়নের খলিষাকুণ্ডি, আড়িয়া ইউনিয়নের চকঘোগা গ্রামে গণহত্যা চালায়। আগস্টের মাঝামাঝি পাকিস্তানি বাহিনী হোসেনাবাদ গণহত্যা সংঘটিত করে। এ গণহত্যায় ২০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ৬ই সেপ্টম্বর হানাদার বাহিনী
গোয়ালগ্রাম গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় ১৭ জন মানুষ শহীদ হন। এছাড়া তাদের প্রাগপুর গণহত্যায় ৩০ জন, খলিষাকুণ্ডি গণহত্যায় ২৫ জন এবং চকঘোগা গণহত্যায় ১০ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
দৌলতপুর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের হোসেনাবাদ, দৌলতপুর থানা, প্রাগপুর, ডাংমড়কা হাইস্কুল ও মহিষকুণ্ডি ইপিআর ক্যাম্প ছিল পাকসেনাদের বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র। এছাড়া আড়িয়া ইউনিয়নের বড়গাংদিয়া রাজাকার ক্যাম্পও বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
দৌলতপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের গোয়ালগ্রাম, প্রাগপুর ইউনিয়নের প্রাগপুর হাইস্কুল, উপজেলা পরিষদের পেছনের পুকুরপাড়, মথুরাপুর ইউনিয়নের হোসেনাবাদ তহসিল অফিস, পাকবাহিনীর খলিষাকুণ্ডি ক্যাম্প এবং আড়িয়া ইউনিয়নের চকঘোগা দাউদ মণ্ডলের বাড়ি ছিল হানাদার বাহিনীর বধ্যভূমি। এপ্রিল মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত এ সমস্ত বধ্যভূমিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে হত্যা করা হয়।
দৌলতপুর উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনয়নের তেকালা ও ধর্মসহ (ব্যাংগাড়ী), আড়িয়া ইউনিয়নের চকঘোগা, প্রাগপুর ইউনিয়নের মহিষকুণ্ডি হাইস্কুলের পেছনে, হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের ফারাকপুর ও রফিকনগর, উপজেলা পরিষদ চত্বর ও পিয়ারপুর ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামে গণকবর রয়েছে। এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত এসব গণকবরে কয়েকশ লোককে গণকবর দেয়া হয়।
দৌলতপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের পর এপ্রিল মাসের শেষদিক থেকে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ, অপারেশন এবং সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। ঐগুলোর মধ্যে গোয়ালগ্রাম আজাহার ফরাজির বাড়ি যুদ্ধ, ভাগজোত যুদ্ধ, শেরপুর যুদ্ধ, ক্রোফড নগর মাঠ যুদ্ধ, বিটিসি মাঠ যুদ্ধ, চিলমারী যুদ্ধ, ওমরপুর যুদ্ধ, তেকালা ব্যাংগাড়ি মাঠ যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রাগপুর ইউনিয়নের গোড়ারপুর ব্রিজের নিকট, মহিষকুণ্ডি মাঠপাড়া, রামনগর, বিলগাথুয়া ও জামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়।
জুন মাসে মহিষকুণ্ডি ভাগজোত কাস্টম এলাকায় হাজী আবুল কাশেম সরোয়ারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক আলী শহীদ হন এবং ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। জুলাই মাসে ফিলিপনগর ইউনিয়নের ফিলিপনগর গ্রামের খয়েরতলা মাঠে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইয়াকুব আলী এবং মুজিব বাহিনীর সহকারী কমান্ডার হায়দার আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মো. আজিজুল ইসলাম আন্টু (পিতা আফাজউদ্দিন কবিরাজ) এবং মহিউদ্দিন আহমেদ পান্টু (পিতা শরেশ প্রামাণিক) শহীদ হন।
আগস্ট মাসে গোড়েরপাড়া এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পাকবাহিনী চিলমারী ইউনিয়ন দখল করার চেষ্টা করলে ২২শে আগস্ট, ৩১শে আগস্ট, ৫ই সেপ্টেম্বর এবং ১২ই সেপ্টেম্বর তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। চিলমারী যুদ্ধে কমান্ডার মো. আলাউদ্দীন, আব্দুল মালেক, মো. শাহজাহান আলী ও আনোয়ার হোসেন নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
আগস্টের শেষদিকে মথুরাপুর ইউনিয়নের মথুরাপুর গরুর হাট এলাকায় আওলাদ হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।
৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গোয়ালগ্রাম আজাহার ফরাজির বাড়ি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তারা গণহত্যা চালায়। গণহত্যায় মুক্তিযোদ্ধা মমিন (রাজবাড়ি), ওয়াজেদ (পাবনা), তফিল উদ্দিন (বাড়ির মালিক) সহ ১৭ জন শহীদ হন। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে উপজেলার খলিষাকুণ্ডি ইউনিয়নে কামালপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের, শাহ আলম ও নুরুল হুদা পালুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করেন। এ মাসেই উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের বড়গাংদিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা শাহ্ আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনা ও রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করেন। ১৭ই অক্টোবর কমান্ডার আব্দুল আজিজের নেতৃতে মহিষকুণ্ডি ক্রোফড নগর মাঠে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
পাকসেনারা দৌলতপুর উপজেলার মহিষকুণ্ডির দিকে যাত্রা করলে হাতিশালা বাজারের পূর্বে ইপিআর, আনসার, সেনাসদস্য, ছাত্র-জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০শে অক্টোবর ভাগজোত গ্রামে পাকবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করেন। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৬ জন সৈন্য নিহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ২০শে অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালামের নেতৃত্বে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাগজোত মাঠে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মহিষকুণ্ডি যুদ্ধে পাকুড়িয়া হাইস্কুলের ছাদের ওপর পাকবাহিনীর সদস্যরা পজিশন নেয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল হাইলি নদীর অপর পাশে হালের দাড়ার মধ্যে। পাকবাহিনী মেশিনগান দিয়ে গুলি করতে- করতে ভাগজোত গ্রামে প্রবেশ করে। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ শহীদ এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অপরদিকে কয়েকজন পাকিস্তানি হানাদার সদস্য নিহত হয়।
নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাগপুর ইউনিয়নের প্রাগপুর পশ্চিমপাড়ায় রতনের বাড়ি সংলগ্ন যুদ্ধে ৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এছাড়া প্রাগপুর ইউনিয়নের ময়রামপুর মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়।
২রা নভেম্বর বড়গাংদিয়া ওমরপুর গ্রামে পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয় এবং তাতে পাকবাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহত হয়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মো. ইদ্রিস আলী মোল্লা ও গ্রুপ কমান্ডার আজগর আলী। এ-যুদ্ধ ওমরপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৪ঠা নভেম্বর মহিষকুণ্ডি মাঠপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন কমান্ডার নজরুল ইসলাম গেরিলা।
১১ই নভেম্বর তেকালার ব্যাংগাড়ি এলাকায় ৩ দিনব্যাপী পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। কমান্ডার লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী, সহকারী কমান্ডার সুবেদার আব্দুল লতিফ, তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী প্রমুখ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী বাংকার থেকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম, সোহবার হোসেন, মোসলেম উদ্দিন এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৩ জন সদস্যকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে এ- যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর চার শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। সকল বিবেচনায় এটি দৌলতপুর উপজেলার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামে ২৭শে নভেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার মো. আফতাব খান ও মো. আব্দুল জলিল। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবর রহমান শহীদ হন এবং ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ২৫শে নভেম্বর রাতে পাকহানাদার বাহিনী শেরপুর গ্রাম আক্রমণ করবে এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আফতাব খান শেরপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে খেয়াঘাটে এম্বুশ নেন। ভোর ৫টার দিকে হানাদাররা শেরপুর গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় অগ্নিসংযোগ শুরু করলে আফতাব খান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ করেন। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল তাঁর দল নিয়ে জগন্নাথপুর গ্রাম থেকে সেখানে গিয়ে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের দুদিক থেকে আক্রমণে হানাদার বাহিনী মাঝখানে পড়ে যায়। এ-যুদ্ধে রাজাকার এবং হানাদার বাহিনীর কয়েকজন নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করেন।
২৭শে নভেম্বর কমান্ডার আবু তাহের, কমান্ডার বকতিয়ার হোসেন, কমান্ডার শাহ আলম ও কমান্ডার নুরুল হুদা পালুর নেতৃত্বে পিপুলবাড়িয়া গ্রামে রাজাকার ও পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৩ জন সদস্য নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম শহীদ হন। এছাড়া প্রাগপুর ইউনিয়নের কুমড়িপাড়া (বিলগাথুয়া) গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। কমান্ডার নজরুল ইসলাম এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলীর নেতৃত্বে হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের বিটিসি মাঠে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম শহীদ এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এ-যুদ্ধে ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন যুদ্ধে ১০৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ৮ই ডিসেম্বর দৌলতপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাবিলদার মো. আতাউর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা আছলেম উদ্দিন মণ্ডল, ইনসাফনগর), অনারারী ক্যাপ্টেন মো. এজাজুল হক খান, বীর প্রতীক (পিতা কিফাত আলী খান, গোয়ালগ্রাম) ও হাবিবুর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা মেহের আলী, শেরপুর)।
দৌলতপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাবিবুর রহমান, বীর প্রতীক (শেরপুর যুদ্ধে শহীদ), রফিকুল ইসলাম (পিতা আসাদ আলী খান, ভেড়ামারা; ফারাকপুর যুদ্ধে শহীদ), আবদুল আজিজ (পিতা আছালত মণ্ডল, বাহীরমাদী), ইপিআর সদস্য আনোয়ার হোসেন (বাহিরমাদী), মো. মোসলেম উদ্দিন (পিতা মো. নূর বক্স মণ্ডল, তেকালা), সোহরাব হোসেন (পিতা মো. নঈমুদ্দিন বিশ্বাস, গরুড়া), নজরুল ইসলাম (পিতা মো. আলাউদ্দিন বিশ্বাস, বাগোয়ান), চান মোহাম্মদ (পিতা রহমতুল্লাহ শেখ, আমদানী ঘাট), ছলিম উদ্দিন (পিতা মো. ওয়াহেদ আলী শেখ, আমদানী ঘাট), ইপিআর সদস্য মো. আফেল উদ্দীন (পিতা মো. এবাদত মণ্ডল, প্রাগপুর), মো. রুকনুজ্জামান (পিতা মো. আবুল কাশেম, প্রাগপুর), মো. আজিজুল ইসলাম (পিতা আফাজ উদ্দিন কবিরাজ, ফিলিপনগর), আবুল কাশেম (পিতা নূর বকস মণ্ডল, গাছেরদিয়ার), জালাল (পিতা মো. চঠু মণ্ডল, দড়িপাড়া), মো. ইনতাজ মোল্লা (পিতা মোহাম্মদ আলী মোল্লা, আমদানী ঘাট), মো. শহিদুল ইসলাম (পিতা মো. আবদুল গফুর, ধর্মদহ), মো. জামাল উদ্দিন (পিতা কাবেল উদ্দিন, কামালপুর), মো. রেজাউল করিম (পিতা মো. ওসমান আলী, শ্যামপুর), তোফাজ্জেল হোসেন (পিতা জৌলুস মণ্ডল, চরপাড়া), মো. রেজাউল হক বিশ্বাস (পিতা মো. ওয়াজেল উদ্দিন বিশ্বাস, মহিষকুণ্ডি), মো. নজরুল ইসলাম (পিতা আকুল, দাড়েরপাড়া), মো. শামসুল হক (পিতা মো. ইব্রাহিম বিশ্বাস, দৌলতখালী), ইছারউদ্দিন (পিতা গোলাদ বিশ্বাস, সালিমপুর), মহিউদ্দিন আহমেদ (পিতা মো. শরেশ প্রামাণিক, ফিলিপনগর), ইলিয়াস হোসেন (পিতা মো. তায়েজ উদ্দিন, দাইরপাড়া), আবদুল ওয়ারেশ (পিতা মো. সোলায়মান, আমদহ), আবদুল আজিজ (পিতা মো. কলিমুদ্দিন মণ্ডল, ভাগজোত), তোফা (পিতা মো. রহিম মণ্ডল, মুসলিমনগর), রইস উদ্দিন (গোকুল সর্দার, মহিষকুণ্ডি), ইসহাক আলী (মহিষকুণ্ডি ভাগজোত কাস্টম যুদ্ধে শহীদ), ইপিআর সদস্য আবদুল মমিন (রাজবাড়ি; গোয়ালগ্রাম আজাহার ফরাজির বাড়ি যুদ্ধে শহীদ), সেনাসদস্য ওয়াজেদ (পাবনা; গোয়ালগ্রাম আজাহার ফরাজির বাড়ি যুদ্ধে শহীদ), তফিল উদ্দিন ফরাজী (গোয়ালগ্রাম, আজাহার ফরাজির বাড়ি যুদ্ধে শহীদ), ইপিআর সুবেদার আজিজুল চৌধুরী (পিতা তোফেল উদ্দিন, ইসলামপুর, ফিলিপনগর)।
দৌলতপুর উপজেলার ফারাকপুর গ্রামে শহীদ রফিকুল ইসলামের নামে একটি স্মৃতিফলক আছে। তাঁর নামে ফারাকপুর গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে রফিকনগর। এ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রফিকুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। উপজেলার কল্যাণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে শহীদ রফিকুল ইসলামের নামে, পিপুলবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মো. রেজাউল করিমের নামে, উপজেলার তারাগুনিয়া ডাকবাংলো চত্বরে শহীদ তোফাজ্জেল হোসেনের নামে এবং মথুরাপুর হাইস্কুল মাঠে শহীদ আব্দুল আজিজের নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। মহিষকুণ্ডি হাইস্কুল চত্বরে শহীদ রেজাউল হক বিশ্বাসের সমাধী স্থলে, প্রাগপুর হাইস্কুল চত্বরে শহীদ রুকনুজ্জামান কচি, আবুল হাশেম সরকার, হাবিলদার মো. আফেল উদ্দীনের নামে, উপজেলার গরুড়া গার্লস হাইস্কুল চত্বরে শহীদ মো. মোসলেম উদ্দীন, সোহরাব হোসেন ও মো. শহীদুল ইসলামের নামে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। এছাড়া উপজেলার শ্যামপুরে শহীদ রেজাউল হক বিশ্বাসের নামে এবং শেরপুরে হাবিবুর রহমানের নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। গোয়ালগ্রাম ফরাজি বাড়ি যুদ্ধে শহীদ ইপিআর সদস্য আবদুল মমিন স্মরণে ধর্মসহ পশ্চিম মাঠে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। এ-যুদ্ধ স্মরণে ফরাজী বাড়িতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে এবং শহীদদের কবর বাঁধাই করে নামফলক লাগানো হয়েছে। পিপুলবাড়ি যুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে পিপুলবাড়ি হাইস্কুলে গড়ে উঠেছে বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধক্ষেত্র স্মৃতিস্তম্ভ। ব্যাংগাড়ি যুদ্ধের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বীর প্রতীক শহীদ হাবিবুর রহমানের নামে মিরপুর প্রধান সড়ক থেকে দৌলতপুর থানা সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [মো. ছাদিকুজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড