মুক্তিযুদ্ধে দেলদুয়ার উপজেলা (টাঙ্গাইল)
দেলদুয়ার উপজেলা (টাঙ্গাইল) মুক্তিযুদ্ধের সময় আলাদা উপজেলা ছিল না। ১৯৮৪ সালে টাঙ্গাইল সদরের পাঁচটি ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী আরো তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে এ উপজেলা গঠিত হয়। তাই দেলদুয়ার উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত কর্মকাণ্ড ছিল টাঙ্গাইল সদর কেন্দ্রিক। টাঙ্গাইল সদরের নেতৃবৃন্দের নির্দেশমতো এ উপজেলায় সংগ্রাম-আন্দোলন পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর এখানে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়।
২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট এবং ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরপর এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু হয়। এতে নেতৃত্ব দেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আব্দুল বাতেন। দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি, এলাসিন হাইস্কুল মাঠ, লাউহাটি হাইস্কুল মাঠ, আটিয়া মাজার সংলগ্ন মাঠ এবং সিংহরাগী ভোম্বলের খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেন বায়েজিদ আলম, সোলায়মান মিঞা, আব্দুল হোসেন, সুবেদার আব্দুল বারী, রোস্তম আলী মাস্টার, মহিউদ্দিন আনসারী, বন্দে আলী মিয়া ও সেনাসদস্য মজিবর রহমান। স্থানীয় ছাত্র-জনতা এঁদের নিকট প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম, খন্দকার আব্দুল বাতেন, মতিয়ার রহমান মতি, সোলায়মান মিয়া, আবু তাহের বাবলু প্রমুখ। ৩রা এপ্রিল মির্জাপুরের সাটিয়াচড়া-গোড়ান এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এখানে উভয়
পক্ষে ব্যাপক যুদ্ধ হয়। একই দিন সাটিয়াচড়া থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে দেলদুয়ারের নাটিয়াপাড়ার বহ্নি ও বাঐখোলা গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে কাদের সিদ্দিকী তাঁর বাহিনী নিয়ে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু এসব প্রতিরোধ ভেঙ্গে ঐদিনই পাকবাহিনী দেলদুয়ারে প্রবেশ করে।
তবে এখানে তারা কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ উপজেলায় যারা বিরোধী
ভূমিকা পালন করে, তাদেরমধ্যে উল্লেখযোগ্য এ কে এম ওয়ালিউল্লাহ (এলাসিন), খোকা রাজাকার (এলাসিন), আনসার আলী সরকার (বীরপুশিয়া) প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হয়। দেলদুয়ার উপজেলায় দুটি গণহত্যা সংঘটিত হয় -এলাসিন গণহত্যা- ૭ পাথরাইল-নলশোদা গণহত্যা-। পাকবাহিনীর দোসর কাজী ওয়ালিউল্লাহর নেতৃত্বে এলাসিন বাজার ও গ্রাম তিনবার আক্রমণের শিকার হয়। এ-সময় বহু সংখ্যক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। ১২ই মে ১৫ জন নারীকে ধর্ষণ ও ৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। এছাড়া এলাসিন ধলেশ্বরীর ঘাটে ১৮ জন ছাত্র- যুবককে হত্যা করা হয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যাচ্ছিল। এসব ঘটনা মে থেকে অক্টোবরের মধ্যে সংঘটিত হয়।
পাথরাইল-নলশোদা গণহত্যা সংঘটিত হয় ৩০শে জুলাই। এ-সময় বীরপুশিয়ার কুখ্যাত রাজাকার আনসার আলীর সহযোগিতায় পাকবাহিনী অভিযান চালিয়ে এ-দুটি গ্রামের ৭ জনকে হত্যা করে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
দেলদুয়ার উপজেলায় অক্টোবর থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো বাঐখোলার যুদ্ধ, মঙ্গলহোড়ের যুদ্ধ, গজিয়াবাড়ি-গমজানির যুদ্ধ, আটিয়ার যুদ্ধ, হিংগানগর যুদ্ধ ও এলাসিনের যুদ্ধ। ডুবাইল ইউনিয়নের বহ্নি ও বাঐখোলা গ্রামের মাঝে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধে ইব্রাহীম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তাঁকে বারপাখীয়া গোরস্তানে সমাহিত করা হয়। পাথরাইল ইউনিয়নের মঙ্গলহোড় গ্রামের পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার জহিরুল হক ডিপটি। তাঁর সহকারী ছিলেন বায়েজিদ আলম। এ-যুদ্ধে মিজানুর রহমান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তাঁকে আটিয়া মাজারে সমাহিত করা হয়। আটিয়া ইউনিয়নের গজিয়াবাড়ি ও গমজানি গ্রামের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার বায়েজিদ আলম। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর গুলিতে তিনজন গ্রামবাসী শহীদ হন এবং তাদের গজিয়াবাড়ি গ্রামে সমাহিত করা হয়। আটিয়া মাজার সংলগ্ন এলাকায় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধে মিজান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হিংগানগরের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার রবিউল আলম গেরিলা। এলাসিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয় দুবার ১২ই অক্টোবর এলাসিন বাজারে এবং ১লা ডিসেম্বর এলাসিন ঘাটে। উভয় যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কাদের সিদ্দিকী। প্রথমবারের যুদ্ধে তিনজন রাজাকার নিহত ও এগারজন আহত হয় এবং বাকিরা ধরা পড়ে। শত্রুদের ১৭টি রাইফেল, তিন হাজার গুলি ও প্রচুর পরিমাণ রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। ১১ই ডিসেম্বর দেলদুয়ার উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- খন্দকার রেজানুর হোসেন, বীর বিক্রম- (পিতা খন্দকার হায়দার আলী, পাচুরিয়া)।
দেলদুয়ার উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- খন্দকার রেজানুর হোসেন, বীর বিক্রম (২৪শে অক্টোবর গোয়াইনঘাট যুদ্ধে শহীদ), আতাহার আলী (পিতা আবুল কাশেম, পড়াইখালী), জিয়ারত আলী (পিতা মোহাম্মদ আলী, শশীনারা), আব্দুল আজিজ (পিতা সমেজ উদ্দিন, ডুবাইল), খন্দকার মিজানুর রহমান (পিতা খন্দকার মোবারক আলী, চালা আটিয়া), গিয়াস উদ্দিন (পিতা বুলু মিয়া, মাদারকোল), খালেকুজ্জামান আল মজিদী (পিতা খালেক সিদ্দিকী আল মজিদী, গজিয়াবাড়ি), আব্দুর রশিদ (পিতা আতর আলী, নান্দুরিয়া), আজিজুল হক (পিতা আবু মোহাম্মদ মিয়া, গজিয়াবাড়ি), ইয়াসিন মিয়া (পিতা আবুল কাশেম, স্বল্পবরাটিয়া), খন্দকার নজরুল ইসলাম (পিতা খন্দকার আব্দুল মান্নান, বেতরাইল), একাব্বর হোসেন (পিতা আবদুস সোবহান মিয়া, রূপসী), জামাল উদ্দিন সোনা (পিতা আব্দুস সাত্তার, ডুবাইল), রমিজ উদ্দিন (পিতা কানু মিয়া, দেলদুয়ার), আসাদুজ্জামান (পিতা আবদুস সবুর মিয়া, কামার নওগাঁ), আব্দুল্লাহ (পিতা আবদুসসালাম মুন্সি, গজিয়াবাড়ি), আব্দুল কাইয়ুম (পিতা তমেজ উদ্দিন, মাদারকোল) এবং লেবু মিয়া (পিতা নূরুল হক সরকার, মাদারকোল)।
দেলদুয়ার উপজেলায় একজন শহীদের নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে – শহীদ শামসুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। [ফাতেমা জোহরা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড