বীর প্রতীক দেলাওয়ার হোসেন
দেলাওয়ার হোসেন, বীর প্রতীক (১৯৪৫-১৯৮১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৫ সালের ১লা এপ্রিল ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সেকান্দার আলী হাওলাদার এবং মাতার নাম মকিমুন নেসা। তিনি ১৯৬২ সালে রাজাপুর হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৪ সালে বরিশাল বি এম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ৪১তম পিএসএ লং কোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের কাকুলস্থ মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ১৯৬৯ সালে তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন। তারপর তাঁকে রাওয়ালপিন্ডি সেনানিবাসে পোস্টিং দেয়া হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে দেলাওয়ার হোসেন পশ্চিম পাকিস্তানে অর্ডিন্যান্স কোরে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তিনি এর প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। আগস্ট মাসে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসে সরাসরি ৬নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রথমদিকে কিছুকাল তিনি সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাঁকে এই সেক্টরের মোগলহাট সাব- সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন স্থানে বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অনেকগুলো যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মোগলহাট রেললাইন অপারেশন। মোগলহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং লালমনিরহাট থেকে তাদের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরববরাহ করা হতো ট্রেনের মাধ্যমে। দেলাওয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ১৫ই সেপ্টেম্বর মোগলহাট রেললাইনে অপারেশনের সিদ্ধান্ত হয়। ঐদিন খুব ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইনের ওপর এন্টি-ট্যাংক মাইন সেট করে অপেক্ষা করতে থাকেন। ট্রেনটির সামনের কয়েকটি বগিতে ছিল বালি ও অন্যান্য জিনিসপত্র ভর্তি। পাকসেনারা ছিল পেছনের বগিগুলোতে। ট্রেনটি টার্গেটে আসামাত্র এন্টি- ট্যাংক মাইন বিস্ফোরণে ইঞ্জিনসহ সামনের বগিগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনারা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। দেলাওয়ার হোসেন হালকা মেশিনগান দিয়ে কভারিং ফায়ার দিতে থাকেন এবং এই ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে যেতে সক্ষম হন। এ অপারেশনে দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং চারজন আহত হন। অপরদিকে পাঁচজন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং বহু সংখ্যক আহত হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার দেলাওয়ার হোসেনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ২৬৪, খেতাবের সনদ নং ১৪)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ব্যক্তিজীবনে তিনি তিন কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নূরজাহান দেলাওয়ার। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর হত্যা মামলায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয় এবং ২৩শে সেপ্টেম্বর এ বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড