You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা (জামালপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা (জামালপুর)

দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা (জামালপুর) রেলপথ ও নদীপথে যোগাযোগের কারণে ব্রিটিশ আমল থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানকার দেওয়ানগঞ্জ বাজার তখন থেকেই একটি সমৃদ্ধ স্থান। অতীতের সব জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে এ উপজেলার জনগণের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর তারা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। আনোয়ারুল আজিম সানার নেতৃত্বে চলে মিটিং-মিছিল। মিছিলে স্লোগান ওঠে, “বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ১২ই মার্চ বিকেল চারটায় আনোয়ারুল আজিম সানা, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র মাহফুজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হারুন হাবীব, আবুল হোসেন, চাঁন মিয়াসহ মুক্তিপাগল তরুণরা শহরের বেলতলী রেলক্রসিং-এ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ পথচারী মনু মিঞাকে দিয়ে পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর এমএনএ আব্দুস সামাদকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের সদস্যরা ছিলেন এডভোকেট আশরাফ হোসেন এমপিএ, এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন এমপিএ, আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক রাশিদুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক বদিউর রহমান তালুকদার, যুবনেতা আ খ ম ইনসান আলী (স্বাধীনতা-পরবর্তী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক), এস এম আবুল কলাম, আনোয়ারুল আজিম সানা, কমিউনিস্ট পার্টি র মুকুল চৌধুরী, শওকতুল হক, কামাল চৌধুরী, চন্দ্রমোহন দাস প্রমুখ। এঁদের নেতৃত্বে দেওয়ানগঞ্জের ছাত্র-যুবকরা আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।
সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিমান বাহিনীর সদস্য রহুল আমীন বাদশাকে প্রধান ও দুলাল তালুকদারকে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ই মার্চ থেকে তাঁরা এলাকার ছাত্র-যুবকদের যুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা দিতে থাকেন। প্রথম পর্যায়ে ৪২ জনকে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হয়। ২৬শে মার্চ থেকে দেওয়ানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে চলে প্রশিক্ষণ। এছাড়া ব্যক্তি-উদ্যোগেও বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। যেমন জিলবাংলা চিনিকল মাঠে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী ও এলাকার শতাধিক তরুণকে সংগঠিত করেন হারুন হাবীব। তাদের প্রশিক্ষণ দেন স্থানীয় আনসার কমান্ডার খুদু মিয়া (পরে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়)। কিন্তু ২৬শে এপ্রিল উপজেলা সদরে পাকবাহিনী প্রবেশের পর মুক্তিযোদ্ধারা চলে যান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জে। সেখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর তাঁরা যান তেলঢালা ও তুরায় উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ শেষ করে তাঁরা বাংলাদেশে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেওয়ানগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- আব্দুস সামাদ এমএনএ, এডভোকেট আশরাফ হোসেন এমপিএ, এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন এমপিএ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশিদুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক বদিউর রহমান তালুকদার, যুবনেতা আ খ ম ইনসান আলী, আব্দুল বারী, আব্দুল হামিদ মিয়া, ডা. সৈয়দুজ্জামান, আনোয়ারুল আজিম সানা, মুকুল চৌধুরী অধ্যাপক সোলায়মান হক, ডা. সাইদুর রহমান, বিকাশচন্দ্র সাহা, সিরাজুল ইসলাম, দিলীপ চন্দ প্রমুখ।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় তিনজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন- গাজী নাসির উদ্দিন, এমারত হোসেন পান্না এবং খায়রুল ইসলাম। এঁরা ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গাজী নাসির উদ্দিন বাহাদুরাবাদ, ফুলছড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, চিলমারী ও গাইবান্ধায় যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এমারত হোসেন পান্না ছিলেন পান্না কোম্পানির কমান্ডার। ১১ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় তাঁর কোম্পানি অপারেশন পরিচালনা করে। কমান্ডার খায়রুল ইসলামও সফলতার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী দেওয়ানগঞ্জে প্রবেশের সময় মুক্তিযোদ্ধারা দেওয়ানগঞ্জ রেললাইন উপড়ে ফেলে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে তাঁরা পশ্চাদপসরণ করেন।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী দেওয়ানগঞ্জ থানায় প্রবেশ করে এবং থানা, জিলবাংলা চিনিকল, আলিয়া মাদ্রাসা ও বাহাদুরাবাদ ঘাটে ক্যাম্প স্থাপন করে।
দেওয়ানগঞ্জে পাকবাহিনী প্রবেশের পর তাদের সহযোগিতায় মুসলিম লীগ – ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর- বাহিনী গঠন করে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি ছিল যথাক্রমে ইসমাইল হোসেন ও মতিউর রহমান তালুকদার। রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল মোনায়েম। কুখ্যাত রাজাকার সুন্নত আলী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আলবদর বাহিনী গঠিত হয় মুসলিম লীগের আলমাছ, ফরিদ গাজী, খুদু মিয়া, আব্দুল হাই চেয়ারম্যান, তসলিম উদ্দিন, মফিজুল হক তালুকদার, আব্দুর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে। এ বাহিনীর কমান্ডার ছিল ডা. মহিউদ্দিন। এদের সঙ্গে আরো ছিল মুসলিম লীগের এ কে এম হক, আব্দুস সামাদ সুলতান, আবুল কালাম আজাদ, ইসমাইল হোসেন, আখতারুল ইসলাম, কারিমুল ইসলাম, আফসার উদ্দিন বিএসসি, হিটলার মাস্টার প্রমুখ।
দেওয়ানগঞ্জে পাকবাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ হন আনোয়ারুল আজিম সানা। তাঁকে এবং তাঁর ভাইকে দালালদের সহায়তায় পাকবাহিনী বাহাদুরাবাদ ঘাট ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। অমানুষিক নির্যাতনের পর ৬ই মে তাঁদের হত্যা করা হয়। এছাড়া আওয়ামী লীগ কর্মী তোফেন আলীকে ট্রেনের ইঞ্জিন বয়লারের ভেতর ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা দেওয়ানগঞ্জের ভাটিপাড়া, সবুজপুর, হাতিবান্ধা, জিগাবাড়িসহ আরো কয়েকটি গ্রাম লুট করে এবং পুড়িয়ে দেয়। এ-কাজে সহায়তা করে দেওয়ানগঞ্জ রেল স্টেশনের বিহারি জনগোষ্ঠী। তাদের প্রভাবশালী নেতা ছিল নূর মোহাম্মদ। তার নেতৃত্বে স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মিলে বিহারিরা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বাঙালিদের ওপর নির্যাতন চালায়।
দেওয়ানগঞ্জে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ছিল বাহাদুরাবাদ ঘাট ক্যাম্প এবং দেওয়ানগঞ্জ কামিল মাদ্রাসা ছিল রাজাকারআলবদরদের নির্যাতনকেন্দ্র। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ লোকজনদের ধরে এনে এখানে বন্দি করে রাখা হতো এবং দিনের পর দিন তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো।
বাহাদুরাবাদ ঘাট ছিল পাকবাহিনীর জন্য কৌশলগত দিক বিবেচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য লোককে ধরে এনে নদীর ঘাটে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিত। এ-কারণে এটি বাহাদুরাবাদ ঘাট বধ্যভূমি নামে পরিচিত। নাব্য সংকটের কারণে ঘাটটি এখন বিলুপ্ত।
দেওয়ানগঞ্জে কমান্ডার এমারত হোসেন পান্নার নেতৃত্বে পান্না কোম্পানি- নামে একটি স্থানীয় বাহিনী ছিল। এ বাহিনী দেওায়নগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকায় সফলতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেওয়ানগঞ্জ ছিল ১১ নং সেক্টরের অধীন। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর (পরবর্তীতে কর্নেল) আবু তাহের। ডলি এবং চাঁদ সুলতানা নামে তাঁর ছোট দুবোনও এ সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
দেওয়ানগঞ্জে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর উল্লেখযোগ্য একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় বাহাদুরাবাদ ঘাট যুদ্ধ। ৩১শে জুলাই মেজর শাফায়েত জামিল, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে সংঘটিত এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা, রাজাকার ও আলবদর হতাহত হয় এবং বাহাদুরাবাদ পাওয়ার জেনারেটর, পাকসেনাদের ব্যবহৃত কয়েকটি রেলওয়ে ইঞ্জিন ও বগি বিধ্বস্ত হয়। এছাড়া ২রা আগস্ট জিলবাংলা চিনিকলে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে পাকসেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে প্রচণ্ড গুলিবিনিময় হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে না পেরে এক পর্যায়ে শত্রুসেনারা পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা চিনিকল ঘাঁটি দখল করেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে লঞ্চযোগে গিয়ে হাতিবান্দায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ আক্রমণ করে এবং জিগাবড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনী এ-সময় আক্রমণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলিবিনিময় হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে না পেরে পাকবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ৬ই ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. এনায়েত হোসেন, বীর প্রতীক- (পিতা তোসাদ্দেক হোসেন, চিকাজানি মিয়াপাড়া)।
দেওয়ানগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আনোয়ারুল আজিম সানা (উপজেলা সদর; ৬ই মে পাকবাহিনীর বাহাদুরাবাদ ঘাট ক্যাম্পে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়), আবুল হাশেম (পিতা লাল মাহমুদ মণ্ডল, পোল্লাকান্দি), আব্দুল বারেক (পিতা আবুল হোসেন, চকারচর) এবং মইনুল হক সাইফুল্লাহ (পিতা হাজী ময়েজ উদ্দিন, বাহাদুরাবাদ)। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার জিলবাংলা সুগার মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলা সদরে দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে দুটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সড়কদুটি হলো শহীদ আবুল হাশেম সড়ক ও শহীদ আব্দুল বারেক সড়ক। এছাড়া বরখাল (ভেড়ামাড়ী)-এ রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাহাদুরাবাদ ঘাট বধ্যভূমিতে নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারি উদ্যোগে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। [সজীব মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড