মুক্তিযুদ্ধে দুমকি উপজেলা (পটুয়াখালী)
দুমকি উপজেলা (পটুয়াখালী) ১৯৭১ সালে পটুয়াখালী সদর থানার অধীনে ছিল। এটি পটুয়াখালী শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ উপজেলার উত্তরে বরিশালের বাকেরগঞ্জ, দক্ষিণে পটুয়াখালী সদর, পূর্বে বাউফল এবং পশ্চিমে মির্জাগঞ্জ ও পটুয়াখালী সদর উপজেলা। বর্তমানে দুমকি উপজেলায় ৫টি ইউনিয়ন রয়েছে। দেশের অন্যান্য এলাকার মতো দুমকিতেও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
উত্তাল মার্চের গণ-আন্দোলনের প্রভাব দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো দুমকির গ্রামে-গঞ্জেও পড়ে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দেশকে যে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা মার্চের শেষদিকে দুমকির মানুষের কাছেও স্পষ্ট হতে থাকে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর দুমকিতে পৌছার পর এখানকার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন।
১৯৭১ সালে পটুয়াখালী সদর থানার অংশ হিসেবে তখনকার দুমকি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কাজ পরিচালিত হয়। তবে দুমকিতে আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট কাজী আবুল কাশেম মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। তিনি অন্য নেতা-কর্মীদের নিয়ে যুদ্ধের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁরা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে ছাত্র- যুবকদের উৎসাহিত ও সংগঠিত করেন।
যুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল মাসে দুমকিতে ছাত্র- যুবকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। স্থানীয় জুবলী স্কুল ময়দানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। কয়েকটি ব্যাচে প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। দুমকি উপজেলার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
দুমকিতে পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে মৌলভী নুরুল হক (রাজাখালী) এবং সেতাব আলী হাওলাদার (উত্তর মুরাদিয়া)- এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা সংগঠিত হয়। এরা রাজাকার বাহিনী গঠন করে। এদের নেতৃত্বে রাজাকাররা সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়।
দুমকি উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকাররা বেশ কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা মুরাদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ মুরাদিয়া গ্রামের আজিজ খানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরে তারা আজিজ খানকে পটুয়াখালী যাওয়ার পথে পেয়ে হত্যা করে। এছাড়া পাকবাহিনী ও রাজাকাররা সোনামুদ্দিন খন্দকার (পিতা মহের উদ্দিন খন্দকার), কার্তিক চন্দ্র দাস (পিতা লক্ষ্মীকান্ত দাস) এবং লক্ষ্মী কান্ত দাস (পিতা কালাচান দাস, লেবুখালী)-কে হত্যা করে।
দুমকিতে রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা একটি আক্রমণ পরিচালনা করেন। নভেম্বর মাসে মুরাদিয়া ও মৌকরণের মাঝামাঝি শ্রীরামপুরের পার্শ্ববর্তী নদীতে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের একটি স্পিডবোটে আক্রমণ করেন।
মৌলভী নুরুল হকের নেতৃত্ব একদল রাজাকার তখন স্পিডবোটে করে অপারেশনে যাচ্ছিল। কাজী মোতালেবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে
রাজাকাররা পালিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর দুমকি উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। দুমকির দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- আব্দুস ছালাম (পিতা জেন্নাত আলী, লেবুখালী) এবং আব্দুর রহমান (পিতা ওচন আলী, পাঙ্গাশিয়া)। দুমকিতে দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে দুটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। লেবুখালী-হাবিবুল্লাহ হাইস্কুল থেকে মৌকরণ বাজার পর্যন্ত রাস্তার নাম দেয়া হয়েছে শহীদ আব্দুস সলাম সড়ক এবং পাঙ্গাশিয়া মাদ্রাসা থেকে পুকুরজনা পর্যন্ত রাস্তার নাম দেয়া হয়েছে শহীদ আব্দুর রহমান সড়ক। দুমকি উপজেলা সদরে নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতা ভাস্কর্য ‘জয়বাংলা’। [মীর জাকির হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড