You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নির্মিত একটি ভাস্কর্য দুর্জয় বাংলা (উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নির্মিত একটি ভাস্কর্য দুর্জয় বাংলা (উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ)

দুর্জয় বাংলা (উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ) বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নির্মিত একটি ভাস্কর্য। এটি দেশের সবচেয়ে নান্দনিক ও আকর্ষণীয় ভাস্কর্যগুলোর একটি। সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে দক্ষিণ- পশ্চিমে ৭ কিলোমিটার দূরে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ মহাসড়কের পাশে চন্ডিদাস গাঁতীতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কার্যালয় চত্বরের আমবাগানে ১৯৯৪ সালে এটি নির্মিত হয়। সিরাজগঞ্জের বিশিষ্ট সমাজসেবী সাইফুল ইসলাম শিশির ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এ ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোক্তা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সহযোগিতায় এ ভাস্কর্যের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বগুড়া কারুপল্লির প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী খোন্দকার আমিনুল করিম দুলাল এটি নির্মাণ করেন। ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দুলাল মারা গেলে তাঁর সহকর্মী আব্দুল করিম ও বিন্দু কুমার কাজটি সম্পন্ন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ ভাস্কর্যটি দেশের উত্তর জনপদের মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত। প্রতিদিন অনেক মানুষ এটি দেখতে আসে। এ ভাস্কর্যের বিষয়, নির্মাণকৌশল ও সৌন্দর্য বিশেষ আকর্ষণীয়। ৩০ ফুট উচ্চতার সৌধটির পুরো অংশ স্টিলের পাতের ফ্রেমে সিসি ঢালাই দেয়া। এর নিচে রয়েছে ত্রিকোণাকৃতির মনোরম বেদি। বেদিতে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা- আন্দোলন-কে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বেদির দক্ষিণ দেয়ালের আয়তন ৯ বাই ৫ ফুট। এ দেয়ালের বামে রয়েছে হানাদারদের প্রতীকী ছবি ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শীর্ষক শিল্পী কামরুল হাসান অঙ্কিত একটি অমর পোস্টার। মাঝে ও শেষে আছে ১৯৭১ সালে প্রবাসী -বাংলাদেশ সরকার-এর তথ্য দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত দুটি পোস্টার। এর একটি ‘বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক সকলেই আজ মুক্তিযোদ্ধা’ ও অপরটি রাইফেল হাতে এক নারীর ছবি ‘বাংলার মায়েরা-মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’। বেদির উত্তর দেয়ালে তথ্য দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত আরো তিনটি পোস্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো হলো— একজন পুরুষের হাতে রাইফেল সম্বলিত ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’, ‘একটি বাংলা অক্ষর অ- আ, ক-খ এক একেকটি বাঙালির জীবন’ এবং ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান – আমরা সবাই বাঙালি’।
বেদির পেছনের দেয়ালের আয়তন ১১ বাই ৫ ফুট। সম্পূর্ণ টাইলসের এ দেয়ালে ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনারের ছবিসহ ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল ও মিছিলে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়া আন্দোলনকারী ছাত্রদের রক্তাক্ত লাশের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পোস্টার ও চিত্রগুলো অফ হোয়াইট টাইলসের ওপর বিদেশী স্টোন পিস দিয়ে নানা রঙের সমন্বয়ে এমন শৈল্পিক কায়দায় নির্মাণ করা হয়েছে, যা দেখে মনে হবে এগুলো একেবারে নতুন ও জীবন্ত।
ভাস্কর্যে ত্রিকোণাকৃতির বেদির ওপর তিনটি মূর্তি দাঁড় করানো হয়েছে। এসব মূর্তির মধ্যে আছে রাইফেল হাতে এক সুঠাম পুরুষ, বাংলাদেশের পতাকা হাতে এক সংগ্রামী নারী ও কোচ (মাছ শিকারের অস্ত্র) হাতে সংক্ষুব্ধ বিল্পবী এক শিশু। মাতৃভাষার আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষের সংগ্রাম ও যুদ্ধের এক অনবদ্য চিত্র দুর্জয় বাংলায় নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন প্রতিভাধর শিল্পী খোন্দকার আমিনুল করিম দুলাল। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অনন্য এ ভাস্কর্যের নির্মাণশৈলী আর নান্দনিকতা প্রতিদিন হাজারো দর্শককে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করে। এখানে এসে সকলে ৭১-এর সূর্য সৈনিকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে। [কল্যাণ ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড