দিলখুশ চা-বাগান যুদ্ধ (জুড়ী, মৌলভীবাজার)
দিলখুশ চা-বাগান যুদ্ধ (জুড়ী, মৌলভীবাজার) সংঘটিত হয় দুবার – ১৭ই জুলাই ও ২০শে জুলাই। প্রথমবারের যুদ্ধে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ১৭ জন আহত হন এবং দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন শরীফুল হক ডালিম আহত হন।
দিলখুশ চা-বাগান যুদ্ধের গুরুত্ব নানা কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। এ-যুদ্ধে ভুল বুঝাবুঝির কারণে নিজেদের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এছাড়া হানাদারদের দোসর একজন নারীর কারণে অধিনায়ক শরীফুল হক ডালিম হানাদারদের গোলার আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। তিনটি পর্বে ছিল দিলখুশ চা-বাগান যুদ্ধের বিস্তৃতি। সীমান্ত থেকে অনতিদূর কুকিরতল সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স থেকে কয়েক মাইল দূরত্বে দিলখুশ চা-বাগান। ৪ নম্বর সেক্টর সদরদপ্তর থেকে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অত্যাগ্রহে জুলাই মাসের ১৭ তারিখ শত্রুর ওপর আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত হয়। নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন হক। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা তজমুল আলী, আবদুল হান্নান, রুহেল আহমদ চৌধুরী বাবু, আতিকুল হক চৌধুরী পন্নি, বেদানন্দ ভট্টাচার্য, জমির আলী, লিয়াকত হোসেন ও ফারুক আহমদ যুক্ত হন দিলখুশ চা-বাগান ক্যাম্প আক্রমণে। এটি পাকবাহিনীর জুড়ী সাব-সেক্টরের অধীনে একটি বড় ও সুরক্ষিত ক্যাম্প ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এরূপ আক্রমণের সিদ্ধান্ত রীতিমত চ্যালেঞ্জিং ছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানের অধিবাসী ছিলেন। পথঘাট দুর্গম এবং নতুন। টাঙ্গাইলের পন্নি পরিবার থেকে শুরু করে জুড়ীর ফারুক আহমদ এবং বিয়ানীবাজার, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গার মুক্তিযোদ্ধারা দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য দিলকুশ চা-বাগানে লড়েছিলেন।
জুড়ী সাব-সেক্টরের সঙ্গে শত্রুসেনাদের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ৩টি কাট অফ পার্টি গঠন করা হয়। প্রত্যেক পার্টিতে ছিল ১২ জন সৈন্য, ২টি এলএমজি-সহ প্রচুর গোলা-বারুদ। জুড়ীর ফারুক আহমদ, হবিগঞ্জের লিয়াকত হোসেন ও নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান এর নেতৃত্বে ছিলেন। অতর্কিতে আক্রমণ করে দখল করে নেয়ার জন্য ছিল তিনটি এ্যাসল্ট টিম। বিয়ানীবাজারের আবুল খায়ের চৌধুরী ছিলেন এরূপ একটি টিমের দায়িত্বে। তাঁর সহকারী সিলেটের আবদুল মুকিত। দ্বিতীয় গ্রুপে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আবদুল হান্নান এবং তাঁর সহকারী বিয়ানীবাজারের জমির আলী। পথপ্রদর্শক লাঠিটিলার সামছউদ্দিন এবং আবদুল মতিন। তিনটি গ্রুপের সমন্বয়কারী মাথিউরার আসাদ উদ্দিন। পেছনে ছিল গোলন্দাজ বাহিনী।
কুকিরতল থেকে রাত ২টায় যাত্রা করে ভোর ৫টার আগেই ক্যাম্পের নিকট পৌঁছে যান বীর যোদ্ধারা। সিদ্ধান্ত হয়, আবুল খায়ের চৌধুরী ও রুহেল আহমদ বাবু ‘জয় বাংলা” স্লোগান দিলে ফায়ারিং বন্ধ করা হবে। কিন্তু ফারুক আহমদ ও লিয়াকত হোসেন ফায়ারিং বন্ধ করতে দেরি করাতে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয় এবং আত্মঘাতী হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলা-বারুদ শেষ হয়ে আসে এবং পাথারিয়া টিলা থেকে পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ আর্টিলারি ছুড়তে-ছুড়তে এগিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা কারখানার মধ্যে আটকা পড়েন। তজমুল আলী ও তাঁর সঙ্গীরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে রাস্তা খুঁড়ে বেরুনোর পথ করে নেন। ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে বিয়ানীবাজারের আবদুল খালিক, চরিয়ার মাসুম আহমদ চৌধুরী চুন্নু, সোনাওর আলী, কুমিল্লার অন্য একজন এবং আর ২ জনের পরিচয় অজ্ঞাত রয়ে গেছে। পথ হারিয়ে আটকা পড়েছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নূরুল কাদির। গাইডরা তাঁকে পরে বের করে আনতে সক্ষম হন। আহত হন মোট ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। কসবার নূরুল ইসলাম টুনু, হেলাল আহমদ, মৌলভীবাজারের বশির উদ্দিন আহমদ, হবিগঞ্জের আরফান উল্লাহ ও লাসাইতলার খায়রুল আলম এ-যুদ্ধে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়েন।
১৯শে জুলাই ক্যাপ্টেন শরীফুল হক ক্যাম্পে এসে নতুন করে আক্রমণের জন্য দুজন লোক চান। গোয়ালবাড়ীর তজমুল আলী ও আবদুল হান্নান এগিয়ে আসেন। তাঁদের নেতৃত্বে ২০শে জুলাই প্রতিশোধ নিতে প্রকাশ্য দিনের বেলা দিলখুশ চা-বাগান ক্যাম্পে পুনরায় আক্রমণ হয়। ক্যাপ্টেন শরীফুল হক গাছে চড়ে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। এ সময় হানাদারদের দোসর এক মহিলা তাঁর অবস্থান পাথারিয়া টিলা ক্যাম্পের পাক হানাদারদের অবহিত করলে তারা সেখান থেকে ১৫৫ ইঞ্চি মর্টারের গোলা ছোড়ে। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। [হাসনাইন সাজ্জাদী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড