স্থানীয় মুক্তিবাহিনী দাস পার্টি (বানিয়াচঙ্গ, হবিগঞ্জ)
দাস পার্টি (বানিয়াচঙ্গ, হবিগঞ্জ) স্থানীয় একটি মুক্তিবাহিনী। ৫নং সেক্টরের অধীন সাব-সেক্টর কমান্ডার- জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান করে বহু অপারেশন পারিচালনা করে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা এ অঞ্চলের মানুষের ওপর নানা অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এ দলটি সর্বদা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সক্রিয় ছিল। জনসম্পৃক্ততা ও জনস্বার্থে পরিচালিত নানা অভিযানের কারণে এক সময় এ দলটি ‘দাস পার্টি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সুনামগঞ্জ শহর পাকবাহিনীর দখলে চলে যাবার পর সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ১১৪ জনের একটি দল শিলং শহরে গিয়ে ওঠে। সেখান থেকে এ দলটিকে প্রশিক্ষণের জন্য গভীর অরণ্যে অবস্থিত মেজর বাট-এর অধীন একটি ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়। মেজর বাট এবং তাঁর সঙ্গী প্রশিক্ষকরা তেমন বাংলা না জানায় প্রশিক্ষণ কৰ্মে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসেন এক প্রত্যয়ী যুবক। তিনি আসামে .লেখাপড়ার সুবাদে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। এই যুবকের নাম জগৎজ্যোতি দাস। তাঁর বাড়ি হবিগঞ্জ মহকুমার আজমিরীগঞ্জ থানাধীন জলসুখা গ্রামে। হাওরাঞ্চলের এই যুবক সুনামগঞ্জ কলেজে ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্র ও সেখানকার নানারকম সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তিনি সুনামগঞ্জ শহরেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে প্রশিক্ষক ও প্রক্ষিণার্থীদের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি হওয়ায় উভয়ের কাছেই তাঁর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রশিক্ষণকালেই তাঁকে ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পের ডিউটি সার্জেন্টের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করা হয়। স্বীয় মেধার কারণে তিনি যুদ্ধের নানাবিধ কলাকৌশল, বিশেষ করে নৌপথে যুদ্ধ বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে এ দলটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে তিন জনের নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়। তম্মধ্যে একজন কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাস। মেজর বাটের প্রিয়ভাজন হওয়ায় তিনি চৌকশ ৪২ জন যুবকের সমন্বয়ে তাঁর দল গঠনের সুযোগ পান। এ দল নিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সমস্ত হাওরাঞ্চলে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেন। তাঁর প্রতিটি অপারেশনে যেমন ছিল দক্ষতার পরিচয়, তেমনি ছিল সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা। বর্ষাকালে হাওরাঞ্চলে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা, আর শুকনো মৌশুমে হেঁটে পথচলা। তাই পাকবাহিনী এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বিচ্ছিন্ন অভিযানের মাধ্যমে জনমনে ভয়-ভীতির সৃষ্টি করে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করত। তাদের এ কৌশল বুঝেই জগৎজ্যোতির নেতৃত্বাধীন দলটি আজ এ-গাঁয়ে, কাল ও- গাঁয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল। জনগণ আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের সহযোগিতা করত। এভাবেই দলটি সমস্ত এলাকায় পরিচিত হয়ে ওঠে। জগৎজ্যোতি দাস-কে তাঁর সহযোদ্ধারা দাস’দা বলে ডাকতেন। এই দাস’দা থেকেই তাঁর নেতৃত্বাধীন দলটি ‘দাস পার্টি’ হিসেবে খ্যাত হয়।
যুদ্ধকালে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ হয়ে মৌলভীবাজার জেলার শেরপুর পর্যন্ত একটি নৌপথ চালু ছিল। জামালগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ-ছাতক পর্যন্ত ছিল আর একটি নৌপথ। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই সিলেটের সঙ্গে পণ্য পরিবহণে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় পাকিস্তান সরকার এক সময় নৌপথকে বেছে নেয়। পাশাপাশি পাকবাহিনী সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ সামগ্রী পরিবহনের জন্যও এ নৌপথকে অধিক গুরুত্ব দিতে থাকে। এমনি প্রেক্ষাপটে হানাদারদের বিরুদ্ধে নৌপথের প্রতিরোধের জন্য দাসপার্টি আক্রমণ চালাতে শুরু করে। কুশিয়ারা নদীতে একটি কার্গো ডুবিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে দাস পার্টির নৌপথে অভিযানের সূচনা হয়। এরপর একের পর এক পাকবাহিনীর বহু সংখ্যক নৌযান ধ্বংস করা হয়। তাদের তৎপরতার ফলে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের নদীতীরবর্তী গ্রামগুলোতে পরিচালিত আক্রমণ হ্রাস পায়। এক সময় এ অঞ্চলের অনেক এলাকাই দাস পার্টির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। দাস পার্টির তীব্র আক্রমণের ফলে কিছু কালের জন্য ঢাকা-শেরপুর রোডে পাকসেনাদের নৌচলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌছে যে, পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা করে যে, এপথ দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব
সরকার নেবে না।
দাস পার্টির বহু সংখ্যক সফল অভিযানের সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। হাওরাঞ্চলের মানুষ দাসপার্টির তৎপরতায় স্বস্থির নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। জগৎজ্যোতির অসাধারণ অবদানের জন্য সমগ্র ভাটি এলাকায় যেমন তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি শত্রুদের কাছেও বিভীষিকা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন। অত্র অঞ্চলের পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা তাঁর আতঙ্কে সদা সন্ত্রস্ত থাকত। দিরাই, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ছাতক এবং কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার কিয়দংশ নিয়ে বিরাট এলাকায় প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে বহু আভিযান পরিচালনা করে এই দাস পার্টি। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড