মুক্তিযুদ্ধে দাউদকান্দি উপজেলা (কুমিল্লা)
দাউদকান্দি উপজেলা (কুমিল্লা) ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে সব আন্দোলন-সংগ্রামে দাউদকান্দি উপজেলার মানুষ সোচ্চার ছিল। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও তারা ব্যাপক সাড়া দেয় এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর এখানকার সর্বস্তরের জনতা মুক্তিযুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে তৈরি হয়।
২৫শে মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দাউদকান্দির ছাত্র- যুবকরা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের ত্রিপুরা যান। সেখানে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আব্দুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ার (পরবর্তীকালে মন্ত্রী) একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পরিচালনা করতেন। দাউদকান্দি থেকে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে অন্তর্ভুক্তি ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন সুবেদার আবদুর রাজ্জাক (আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি)। উপর্যুক্ত দুজনসহ মো. খোরশেদ আলম, নজরুল ইসলাম (সুন্দলপুর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ও ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগ-এর সাধারণ সম্পাদক), আব্দুল মতিন মাস্টার (তিতাস), শফিক কমান্ডার, মোহাম্মদ শাজাহান প্ৰমুখ দাউদকান্দিতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন নজরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন মাস্টার, শফিক ও শাহজাহান।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনী দাউদকান্দি উপজেলায় প্রবেশ করে এবং ডাকবাংলো, সার্কেল
অফিস, দাউদকান্দি হাইস্কুল ও শহীদ নগর ওয়ারলেস অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
দাউদকান্দি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিদের মধ্যে ডা. তমিজ উদ্দিন আহমেদ, সুলতান আহমেদ চৌধুরী (দাউদকান্দি), এম এ সামাদ সরকার, এ এ লতিফ (জিয়ারকান্দি), শায়েব আলী চৌধুরী (দাউদকান্দি), আফাজ উদ্দিন (দাউদকান্দি) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের সহায়তায় শান্তি কমিটি – ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এম এ সামাদ সরকার ছিল কুমিল্লা জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক। আর শায়েব আলী চৌধুরী, তমু প্রমুখ ছিল রাজাকার বাহিনীর সদস্য। এদের সহায়তায় পাকবাহিনী উপজেলায় হত্যা, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। তারা সাতপাড়া স্বর্ণকার বাড়িসহ বেশকিছু বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ২৩শে মে রায়পুর খাল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ১২ জন সাধারণ লোককে হত্যা করে। এ ঘটনা রায়পুর গণহত্যা নামে পরিচিত। দাউদকান্দি ডাকবাংলো ছিল পাকসেনাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রধান কেন্দ্র। এখানে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। নারীনির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হতো। পাকসেনাদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য রাজাকাররা বাঙালি নারীদের এখানে ধরে আনত এবং তাঁদের ওপর চলত পাশবিক নির্যাতন। তাঁদের করুণ আর্তনাদে চারদিকের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠত। এছাড়া শহীদ নগর ওয়ারলেস অফিস ক্যাম্পেও নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চলত।
দাউদকান্দি উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি রয়েছে— গোমতীঘাট বধ্যভূমি ও শাহপাড়া ব্রিজ বধ্যভূমি। এ-দুটি স্থানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ লোকজনদের ধরে এনে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো।
দাউদকান্দি উপজেলায় কাদেরিয়া বাহিনী- বা হেমায়েত বাহিনী-র মতো স্থানীয় কোনো বাহিনী ছিল না। তবে চরগোয়ালীর ফকিরবাড়িতে আব্দুস সালাম ফকিরের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি স্থানীয় ইউনিট গড়ে তোলা হয়।
দাউদকান্দি উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো— গোমতী নদীতে স্পিডবোট অপারেশন, দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশন এবং গোয়ালমারি-জামালকান্দি যুদ্ধ। ১৩ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা দাউদকান্দির উত্তরে পাকসেনাদের টহলরত একটি স্পিডবোটে হামলা করলে একজন পাকিস্তানি লেফটেন্যান্ট ও ২০ জন সেনা নিহত হয়। পরের দিন মুক্তিযোদ্ধারা শহীদনগর ওয়ারলেস স্টেশন ও ইলিয়টগঞ্জ সেতু ধ্বংস করে দেন। চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে দাউদকান্দি ফেরিঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র ও অন্যান্য যুদ্ধ-সরঞ্জাম আনা-নেয়া বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৬ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নৌকমান্ডো দল আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার ফেরি ও পন্টুন ডুবিয়ে দেয়। ২০শে নভেম্বর গোয়ালমারি-জামালকান্দিতে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এতে বহু পাকসেনা নিহত এবং ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবরে দাউদকান্দি ও চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহে পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৮ই ডিসেম্বর রাতে তাঁরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করলে তারাও পাল্টা জবাব দেয়। এরপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ইলিয়টগঞ্জ ও শহীদনগর ক্যাম্প ছেড়ে ডাকবাংলোয় অবস্থিত প্রধান ক্যাম্পে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারাও মোহাম্মদপুর, ডাকখোলা, গোয়ালমারি, বাতাকান্দি প্রভৃতি ক্যাম্প থেকে দাউদকান্দির দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। অতঃপর পাকসেনারা উপায়ান্তর না দেখে ৯ই ডিসেম্বর বিকেলে ডাকবাংলো থেকে ৪টি জাহাজে করে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। সেদিনই সন্ধ্যার পূর্বে মুক্তিযোদ্ধারা দাউদকান্দি সদরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— মতিউর রহমান, বীর উত্তম (পিতা জয়নুদ্দিন ডাক্তার),
কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীক (পিতা কাজী আবদুল মুত্তালিব, চৌসই, ইলিয়টগঞ্জ) ও মমিনুল হক ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (পিতা সিরাজুল হক ভূঁইয়া, কালা সাদাধিয়া)।
দাউদকান্দি উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নজরুল ইসলাম (সুন্দলপুর), মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ (রবকোটা), আব্দুস সামাদ (সবজিকান্দি), আব্দুল (আমিরাবাদ), নওয়াব মিয়া (তুলাতলী), মোহাম্মদ মাহফুজ মিয়া (মানিককান্দি), মোহাম্মদ নাসের (থৈরখোলা) এবং আজগর আলী ব্যাপারী (চরচারুয়া)। দাউদকান্দি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্বরোডের পাশে মুক্তিযুদ্ধ স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া গোয়ালমারি-জামালকান্দি যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে গোয়ালমারি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে (অসম্পূর্ণ)। হাসানপুরে শহীদ নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া তিনজন শহীদের নমে তিনটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— শহীদ ইসমাইল সড়ক (ঢাকারগাঁও), শহীদ রুহুল আমিন সড়ক (গাজীপুর) এবং শহীদ সামাদ সড়ক (সবজিকান্দি)। [বাশার খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড