You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪৫) বীর মুক্তিযোদ্ধা, অনারারি ক্যাপ্টেন, সাব-সেক্টর কমান্ডার, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি
ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা। ১৯৪৫ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামে
তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম শাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী এবং মাতার নাম সুফিয়া চৌধুরী। তিনি বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং ১৯৬১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৫ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের লীডস ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা এবং ১৯৮৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।
সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) অফিসার হিসেবে ১৯৬৮ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এর দুবছর পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমান জেলা) এসডিও ছিলেন। মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে মেহেরপুরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনাক্রমে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। সে অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথমে প্রতিরোধযুদ্ধ, এরপর সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস থেকে কমিশন লাভ করেন।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের পরপর তিনি ঐ বর্বর হামলার সংবাদ মেহেরপুরে মাইকে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। একদল যুবককে দিয়ে মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করে মেহেরপুরকে চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। ২৬শে মার্চ অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি নদীয়া জেলা প্রশাসক ও ভারতের জনগণকে সরকারি সীল মোহর ব্যবহার করে দুটি চিঠি লেখেন। ভারতের জনগণকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিটি অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চিঠি পেয়ে নদীয়া জেলা প্রশাসক ও বিএসএফ-এর অধিনায়ক সাক্ষাতের জন্য তাঁকে বেতাই বিওপিতে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে সাক্ষাৎ শেষে পরদিন তিনি চুয়াডাঙ্গা যান। চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর উইং-এর বিদ্রোহের খবর তাঁর কাছে আগে থেকেই ছিল। এর মধ্যে ৩০শে মার্চ চুয়াডাঙ্গার ইপিআর-এর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, -আওয়ামী লীগ-এর অন্যতম শীর্ষ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ এবং ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর- উল ইসলামকে ভারতে নিরাপদে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেন। পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁদের ঐদিনই বেতাই বিওপিতে নিয়ে যান। এরপর বিওপি থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মেহেরপুরে ফিরে আসেন। ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত বেতাই বিওপি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় ৷ এদিকে ৩০-৩১শে মার্চ কুষ্টিয়া শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয় এবং কয়েক দিনের জন্য কুষ্টিয়া শহর হানাদারমুক্ত হয়। যুদ্ধে কয়েকশ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার-এর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকার গঠনের পর তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্ত তিনি ঐ দায়িত্বের চেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। অতএব তাঁকে ৮ নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। পরে তিনি বেনাপোল সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও বৃহত্তর যশোর জেলার বিষয়খালী যুদ্ধ-এ তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বেনাপোল ও শিকারপুর উপজেলার বিভিন্ন অপারেশনে তিনি সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। এর মধ্যে পুটুখালীর যুদ্ধ (১২ই সেপ্টেম্বর) অন্যতম।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। ২০০২ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানেও তিনি একই পদে বহাল রয়েছেন। তিনি তাঁর জীবনস্মৃতি নিয়ে Chariot of Life: Liberation War, Politics and Sojourn in Jail শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ২ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মোছা. আছমা চৌধুরী। [জেবউননেছা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড