You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.26 | তেলিগাতী যুদ্ধ (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট) - সংগ্রামের নোটবুক

তেলিগাতী যুদ্ধ (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট)

তেলিগাতী যুদ্ধ (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় তিন দফায়— ২৬শে মে, ২৯শে মে ও ৭ই আগস্ট। এতে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধা উভয় পক্ষে হতাহত হয়৷
২৬শে মে দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্পের অন্যতম সংগঠক, পঞ্চকরন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মুসলিম লীগ নেতা ও রাজাকার কমান্ডার মোক্তার আলী খান তার বাহিনী ও পিরোজপুরে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে নিয়ে তেলিগাতী গ্রাম আক্রমণ করে। তেলিগাতী স্কুলে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এ আক্রমণের শিকার হয়। হানাদার বাহিনীর অগ্রবর্তী দল হিসেবে মোক্তার আলী খান রাজাকারদের নিয়ে তেলিগাতী মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছলেমান খান খোকনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। এক পর্যায়ে রাজাকার মোক্তার আলী খান মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে গুরুতর আহত হয় ও একজন রাজাকার নিহত হয়। এ-যুদ্ধে রাজাকাররা পরাজয় মেনে যখন পলায়ন করছিল, তখন পাকবাহিনী তেলিগাতী বাজারে পৌঁছায়। সেখানে পৌঁছেই তারা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প লক্ষ করে মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে। গোলার আঘাতে দুই সহোদর বীর মুক্তযোদ্ধা আব্দুল জব্বার খান ও আব্দুল মান্নান খান শহীদ হন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কমান্ডার ছলেমান খান তাঁর সহ-মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হাওলাদার বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের এ অবস্থান রাজাকার ও হানাদার বাহিনী জেনে যায়। তারা হাওলাদার বাড়ির দিকে রাইফেল ও মর্টারের গুলি নিক্ষেপ করতে থাকে। আশ্রয়স্থল নিরাপদ নয় ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অস্ত্রশস্ত্রসহ নিরাপদ স্থানে সরে যান। এ সুযোগে হানাদার বাহিনী হাওলাদার বাড়ির ওপর চড়াও হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে হাওলাদার বাড়ির একই পরিবারের ৫ জনসহ মোট ৯ জনকে তারা হত্যা করে। পরবর্তীতে তেলিগাতী ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় সংগঠিত হন। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার আলী মীরের বাড়ির নিকটবর্তী স্থানে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করেন। এ ঘাঁটি থেকে দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা বিরতি দিয়ে বারবার আক্রমণ পরিচালনা করেন।
২৯শে মে মঙ্গলবার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল তেলিগাতী গ্রামের রেহেন খানের বাড়ি থেকে রঘুদত্তকাঠি অপারেশনে যায়। মোক্তার আলী মীরসহ সেখানে অল্প কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর পেয়ে অতর্কিতে রেহেন খানের বাড়ি আক্রমণ করে। দুপক্ষের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণকান্ত গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর আঘাত ছিল গুরুতর। হাবিবুর রহমান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন। ফেরার পথে হাবিবুর রহমান রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাঁকে ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে।
৭ই আগস্ট শনিবার পাকহানাদার ও রাজাকারদের যৌথ বাহিনী দ্বিতীয়বার তেলিগাতী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করে। ছলেমান খান খোকনের বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালায়। সারাদিন ব্যাপক গোলাগুলি করেও রাজাকার ও পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সন্ধ্যার দিকে পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে ছলেমান খান মারাত্মক আহন হন। পাকসেনারা বাঁশি বাজিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে যায়। এ-যুদ্ধের পর তেলিগাতীর মুক্তিযোদ্ধারা আরো শক্তি সঞ্চয় করে সুসংগঠিত হন। নভেম্বরের আগ পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের তৈরি বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে কয়েকবার দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। [শেখ মশিউর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড