প্রখ্যাত ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ
তোফায়েল আহমেদ (জন্ম ১৯৪৩) প্রখ্যাত ছাত্রনেতা, ৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থানের নায়ক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও আওয়ামী লীগ-এর শীর্ষস্থানীয় নেতা। ১৯৪৩ সালের ২২শে অক্টোবর ভোলা জেলা সদরের অদূরবর্তী কোড়ালিয়া গ্রামে জন্ম। পিতার নাম আজাহার আলী ও মাতা ফাতেমা খানম। স্থানীয় ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া শুরু। খায়েরহাট জুনিয়র হাইস্কুলে কিছুদিন পড়ার পর বাড়ি থেকে ৭ মাইল দূরে বোরহান উদ্দীন হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কোনো হোস্টেল না থাকায় তাঁকে লজিং থাকতে হয়। সেখান থেকে তিনি ভোলা সরকারি হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিজ্ঞান শাখায় ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি বরিশাল বি এম কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে আইএসসি ও ১৯৬৪ সালে বিএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬৬ সালে একই বিষয়ে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল)-এর আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ প্রথম থেকেই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ক্রমান্বয়ে তাঁর রাজনৈতিক সত্তার পরিস্ফুটন ঘটতে থাকে। নেতৃত্বের সম্ভাবনা সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে লক্ষ করা যায়। তিনি স্কুল জীবনে ক্লাস ক্যাপ্টেন ও স্কুল ক্যাপ্টেন ছিলেন। তাঁর রাজনীতির প্রথম পাঠ ১৯৫৭ সালে। তখন তিনি ভোলা সরকারি হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। প্রাদেশিক পরিষদের একটি উপনির্বাচন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ভোলা সরকারি কলেজ মাঠে জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। তাঁদের বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। সেদিন মনে-মনে সিদ্ধান্ত নেন, কোনোদিন রাজনীতি করলে ‘এই নেতার রাজনীতি করব।’ বস্তুত সেদিন থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন ভক্তে পরিণত হন, যা পরবর্তীতে আরো গভীর ও ঘনিষ্ঠ হয়েছে এবং এখনো বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা হৃদয়ে ধারণ করে আছেন।
বি এম কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় তোফায়েল আহমেদ কলেজ ছাত্র সংসদে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তিনি সাবেক ইকবাল হলের ক্রীড়া সম্পাদক ও ১৯৬৯ সালে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-৭০ পর্বে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ-এর সভাপতি ছিলেন। ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ খ্যাত বাঙালির মুক্তিসনদ বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা কর্মসূচি-ভিত্তিক (১৯৬৬) আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান ঘটে ১৯৬৯ সালে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর আইয়ুব সরকার তাঁকে ১ নম্বর আসামি করে আগরতলা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে (১৯৬৮)। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বাঙালির জাতীয় মুক্তির আন্দোলন নস্যাৎ করে দিয়ে বাঙালিদের চিরদিনের জন্য পদানত করে রাখা। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ অভিযুক্তদের ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্য শুরু হলে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে জেগে ওঠে। ৪টি ছাত্র সংগঠন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ১১-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। ডাকসুর সহ- সভাপতি ও অনলবর্ষী বক্তা তোফায়েল আহমেদ ছিলেন এ আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে। সংঘটিত হয় আইয়ুববিরোধী ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। তোফায়েল আহমেদ হলেন এ গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক। ২২শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব সরকার নিঃশর্তে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরের দিন রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ ১০ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ (বাংলা বা বাঙালির বন্ধু) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আইয়ুব খানের পতনের পর নতুন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬-দফা কর্মসূচির প্রশ্নে বাঙালিদের ম্যান্ডেট লাভের লক্ষ্য নিয়ে ঐ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয় এবং সমগ্র দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারে তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন ও বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা করেন। একই বছর ১২ই নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষের জীবনহানিসহ ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা ঘটে গেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বিপন্ন মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। উপকূলীয় এলাকাসমূহে নতুন তফশিল অনুযায়ী অনুষ্ঠিত (১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১) নির্বাচনে মাত্র ২৬ বছর বয়সে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ভোলা থেকে তোফায়েল আহমেদ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নিকট কিছুতেই প্রত্যাশিত ছিল না। তাই নির্বাচনী রায় বাঞ্চাল করতে তারা নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে ৩রা মার্চ ১৯৭১ অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মাত্র দুদিন পূর্বে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত ঘোষণা করা হলে প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন যা ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে বাঙালি হত্যার অভিযান শুরুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত চলে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতিসহ বাঙালিদের করণীয় সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু এর পূর্বে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে এক দিকনির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পূর্বক্ষণে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এ সময় মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে তোফায়েল আহমেদ ভারতে যান। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং তিনি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও যুবকদের অন্তর্ভুক্ত করে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) নামে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন, যা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠাতাদের এ ৪ জন চারটি অঞ্চলের অধিনায়ক ছিলেন। বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশের মাটিতে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তোফায়েল আহমেদকে তাঁর রাজনৈতিক সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন। ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঐ পদে বহাল ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা দখলকারী চক্রের সদস্যরা তাঁকে পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও রেডিও অফিসে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। একই বছর ৬ই সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তিনি টানা ৩৩ মাস কারান্তরালে ছিলেন। জেনারেল এরশাদের শাসন আমল (১৯৮২-১৯৯০), বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের সময় (১৯৯১-১৯৯৬) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১- ২০০৬) তাঁকে একাধিকবার গ্রেফতারবরণ করে দীর্ঘ সময়ের জন্য কারা অভ্যন্তরে কাটাতে হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে (৭-৮ই এপ্রিল ১৯৭২) তোফায়েল আহমেদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে তাঁর দলের কেন্দ্ৰীয় নেতৃত্বে উত্থান ঘটে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলকে নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি জাতীয় দল গঠন করলে তোফায়েল আহমেদ এর ৩ জন সম্পাদকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৭ সালে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন (বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর স্ত্রী)-কে আহ্বায়ক করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার এক বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে (৩-৫ই মার্চ ১৯৭৮) তোফায়েল আহমেদ সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালের কাউন্সিলে তিনি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। তোফায়েল আহমেদ স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ মোট ৬ বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ১২ই জানুয়ারি থেকে তিনি শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদের সরকারে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তোফায়েল আহমেদ বরেণ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীনে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে বিশিষ্ট ভূমিকা পালনের মাধ্যমে তিনি দেশের ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড