মুক্তিযুদ্ধে তাহিরপুর উপজেলা (সুনামগঞ্জ)
তাহিরপুর উপজেলা (সুনামগঞ্জ) হাওড় বেষ্টিত একটি জনপদ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ জনপদের প্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগ-এর মনোনয়নে আব্দুল জহুর মিয়া এমপিএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর তাঁর নির্দেশ অনুসারে তাহিরপুরের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
৭ই মার্চের পর থেকে আব্দুল জহুর মিয়া এমপিএ-র নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাহিরপুরের গ্রামে-গঞ্জে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। ২৩শে মার্চ তাহিরপুর থানা থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫শে মার্চ আব্দুল জহুর মিয়া এমপিএ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে তাহিরপুর থানার ওসি শফিকুর রহমান (মিরেরসরাই, চট্টগ্রাম)-কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য শপথবাক্য পাঠ করান। ২৬শে মার্চ থেকেই শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে তাহিরপুর থানায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেখানে শতাধিক ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
২৭শে মার্চ পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে তাহিরপুরে লাঠি মিছিল করা হয় এবং এদিনই গঠন করা হয় তাহিরপুর থানা সংগ্রাম কমিটি। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন আব্দুল জহুর মিয়া এমপিএ, সহ-সভাপতি রমেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী (তাহিরপুর), সাধারণ সম্পাদক নূরুল হুদা (গোবিন্দশ্রী) এবং কোষাধ্যক্ষ আব্দুন নূর আখঞ্জি (ঠাকুরহাটি)। সদস্যদের মধ্যে গোলাম মোস্তফা (তাহিরপুর), মোজাহিদ উদ্দিন আহমদ (বাদাঘাট), আবু তাহের (গুটিলা), আবুল হোসেন খান (বানিয়াগাঁও), আব্দুল কদ্দুস (বড়দল), ফতে আলী মজুমদার (বালিজুরী), আব্দুস সাত্তার তালুকদার (শ্রীপুর), আব্দুল খালেক (কাউকান্দি), আব্দুল আজিজ (সূর্যেরগাঁও), নারায়ণ চক্রবর্তী (সূর্যেরগাঁও), আলী আমজাদ (তাহিরপুর), কালু মিয়া (আনসার কমান্ডার, তাহিরপুর), আম্বর আলী (আনসার কমান্ডার, তাহিরপুর), হাজি সুরুজ মিয়া (নাগরপুর), রবিউল আউয়াল (নাগরপুর), ডা. সিরাজুল ইসলাম (বাদাঘাট), আব্দুল মজিদ (শিবেরচর), কালু মেম্বার (যুদাইরচর), জালাল উদ্দিন (যুদাইরচর), লায়েছ চেয়ারম্যান (সিরাজপুর), আব্দুস সাত্তার (দুর্গাপুর), হাজি আব্দুল কাছির (শক্তিয়ারখলা), আব্দুস সালাম (বালিজুরী), আব্দুর রউফ (রামজীবনপুর), মকবুল হোসেন মাস্টার (পাটাবুকা), সুবেদার গণি তালুকদার (তাহিরপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তাহিরপুরের টেকেরঘাটে চুনাপাথর প্রকল্পের কর্মকর্তা এ কোরেশীর নেতৃত্বে সেখানকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়।
১০ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী তাহিরপুরে অনুপ্রবেশ করে এবং তাহিরপুর সিও অফিস ও তাহিরপুর তহসিল অফিসে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে।
মে মাসের প্রথম দিকে তাহিরপুরে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর সদস্যদের মধ্যে আহমদ মল্লিক (মল্লিকপুর), সুরুজ আলী (নোয়াবন্দ), চান মিয়া (রতনশ্রী), সিরাজুল ইসলাম (বড়কাড়া), নিজামউদ্দিন (ঘাগটিয়া), নূরুল ইসলাম (তাহিরপুর), জালাল উদ্দিন (বড়দল), আলফাজ উদ্দিন (বড়দল), কুরবান আলী (তাহিরপুর), ফজলুল হক (তাহিরপুর), উস্তার আলী (বড়দল), সামছুল হক (তাহিরপুর), আব্দুর রহমান (সুলাহা), মর্তুজ আলী (মল্লিকপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী তাদের দোসর শান্তি কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় তাহিরপুর থানার সূর্যেরগাঁও, উজান তাহিরপুর ও সোলোমানপুর গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষে তাহিরপুর থেকে পাকসেনারা শ্রীপুর এলাকায় টহলে গেলে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, তোতা মিয়া, আব্দুল বারেক, চিত্তরঞ্জন দাশ, আব্দুর রউফ প্রমুখ টহলরত তাদের ওপর গেরিলা আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। অক্টোবর মাসে মোজাহিদ উদ্দিনের নেতৃত্বে আলী আমজাদ, মোস্তফা মিয়া, বুরহান উদ্দিন, আলাউদ্দিন, আব্দুল বারেক, বিলাল মিয়া, কলন্দর মিয়া, নূর মিয়া প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা বিননগরে টহলরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। পাকবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ৯ই নভেম্বর আব্দুল হাই ও মোজাহিদ উদ্দিনের নেতৃত্বে তাহিরপুর হানাদার ক্যাম্পে আক্রমণ চালানো হয়। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। পক্ষান্তরে পাকবাহিনীর গুলিতে আবুল কাশেম (কালিপুর, জামালগঞ্জ) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনের নেতৃত্বে তাহিরপুর থানায় স্থাপিত হানাদার ক্যাম্প আক্রমণ করলে পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে জামালগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। ৪ঠা ডিসেম্বর তাহিরপুর থানা হানাদার মুক্ত হয়।
তাহিরপুর উপজেলায় ৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন- আনসার আলী (পিতা আব্বাস আলী, উজান তাহিরপুর), আব্দুল আউয়াল (পিতা কটু মিয়া, উজান তাহিরপুর), আব্দুল হক (পিতা ওছিয়াত উল্লা, খালিয়াজুড়ি), আব্দুল গফুর (পিতা কদম আলী, উজান তাহিরপুর), আজিম উদ্দিন (পিতা ইসমাইল মুনসী, উজান তাহিরপুর), আবুল কালাম (পিতা গাবরু মিয়া, শিবরামপুর) এবং প্রফুল্ল চন্দ্র তালুকদার (পিতা পরমেশ তালুকদার, ভবানীপুর)। ২০১৪ সালে টেকেরঘাটে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [গোলাম সারোয়ার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড