মুক্তিযুদ্ধে তিতাস উপজেলা (কুমিল্লা)
তিতাস উপজেলা (কুমিল্লা) ২০০৪ সালে দাউদকান্দি উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সারা দেশের মতো তিতাসের লোকজনও তার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও গাজীপুর খান স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আবদুল মতিন মাস্টার ছিলেন তখন ন্যাপ-এর কুমিল্লা জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কৃষক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কুমিল্লা জেলার সহ-দলপতি। চিকিৎসক আবদুল বারীর নেতৃত্বে এলাকার উন্নয়নের জন্য বাতাকান্দি সরকার সাহেব আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। ঐ জনসভায় কুমিল্লায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে পুলিশের গুলিতে গাজীপুরের শাহ আলম ও সাগরফেনার কালুর মা নিহত হন, গুলিবিদ্ধ হয় আরো ৯ জন। এসব ঘটনা তিতাসবাসীকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলন-এর মধ্য দিয়ে সেই বিক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শোনার পর তিতাসবাসী উপলব্ধি করতে থাকে যে, পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির উপায় মুক্তিযুদ্ধ। তাই আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তারা প্রস্তুত হতে থাকে। ২৫শে মার্চর ভয়াবহ ঘটনার পর মুক্তিযুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়লে যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ এলাকার তরুণরা প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। আবদুল মতিন মাস্টারের নেতৃত্বে ৭ জন যুবক ১লা এপ্রিল ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যান। একই দিন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ২ নম্বর সেক্টরের মেজর হায়দারের নেতৃত্বে ভারতের মেলাঘরে গিয়ে প্ৰশিক্ষণ নেয়। দাউদকান্দির প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশিদ ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্থাপিত ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক। পর্যায়ক্রমে তিতাসের ১৪৬ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাইদুর রহমান ঢাকার পুরানা পল্টনে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণে তিতাসের কয়েকজন পুলিশ রক্তাক্ত অবস্থায় পুরানা পল্টন দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তাঁরাও বাড়ি এসে পরে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিতাস উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশিদ এমপিএ, ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক (পিতা মুন্সী আসকর আলী, বন্দরাপুর; তিতাস, হোমনা, দাউদকান্দি ও গজারিয়া ইউনিটের সংগঠক), আবদুল মতিন মাস্টার (পিতা মুন্সী আবদুল লতিফ, কানাইনগর), সায়েদ উল্লাহ খান (পিতা আলী হায়দার খান, গাজীপুর), মোবারক হোসেন ভূঁইয়া (পিতা আবদুল খালেক ভূঁইয়া, বিরামকান্দি), আলী হায়দার মাস্টার (পিতা আলী আকবর সরকার, জগৎপুর), সিদ্দিকুর রহমান (পিতা মো. মোছন্দালী সরকার, মজিদপুর), আবদুল ওহাব সরকার (পিতা নাজিম উদ্দিন সরকার, জিয়ারকান্দি; নারান্দিয়া ও জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের সংগঠক), সামছুল হক (পিতা ছায়েদ আলী, কদমতলী), এ বি এম নুরুল ইসলাম (পিতা মুনজুর আলী সরকার, বাতাকান্দি; বাতাকান্দি বাজার ইউনিটের সংগঠক) এবং আবদুল আউয়াল মাস্টার (পিতা কাজী হাফিজ উদ্দিন খান, খলিলাবাদ; আসমানিয়া বাজার ইউনিটের সংগঠক)।
জগৎপুর গ্রামের নায়েক সুবেদার (পরবর্তীতে অনারারি ক্যাপ্টেন) ফজলুল হক ছিলেন দাউদকান্দি, হোমনা ও গজারিয়া থানার সহকারী ইউনিট কমান্ডার এবং বন্দরামপুর গ্রামের আবদুল মতিন ছিলেন দাউদকান্দি থানা কমান্ডার। আবদুল মতিন মাস্টার ছিলেন তিন থানার গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার। এছাড়া সাইদুর রহমানও একজন কমান্ডার ছিলেন। থানা কুরিয়ার (বার্তাবাহক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোশাররফ হোসেন আনসারী।
তিতাস উপজেলা নদীতীরবর্তী নিম্নভূমি হওয়ায় পাকবাহিনী এ অঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে থাকেনি। উপজেলার অধিকাংশ গ্রাম গোমতী ও তিতাস নদীর পাড়ে অবস্থিত। তাই পাকবাহিনী মাঝে-মধ্যে নদীপথে এসে গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালাত। তবে মুক্তিযোদ্ধারাও এ ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতেন। তাই পাকবাহিনী এখানে উল্লেখযোগ্য তৎপরতা চালাতে পারেনি।
তিতাস উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কেউ ছিল না বললেই চলে। এখানকার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করে।
দাউদকান্দি উপজেলা সদরের ডাকবাংলোতে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে পাকসেনারা মাঝে-মধ্যে লঞ্চে করে এসে গোমতী ও তিতাস পাড়ের গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালাত। এমনিভাবে তারা বাতাকান্দি সরকার বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয় এবং সরস্বতীর চরে ৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। হত্যার এ ঘটনাটি সরস্বতীর চর গণহত্যানামে পরিচিত। তাই এ গ্রামগুলোকে পাকবাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে এরপর আর অনুরূপ ঘটনা ঘটেনি।
তিতাসে পাকবাহিনীর কোনো নির্যাতনকেন্দ্র ছিল না। তারা দাউদকান্দি ডাকবাংলো থেকে এসে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বাড়িঘরে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে আবার দাউদকান্দিতে ফিরে যেত।
তিতাসে একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে- সরস্বতীর চর গণকবর। ৩রা নভেম্বর পাকসেনারা এখানে ৮ জন নিরপরাধ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে এবং এই চরেই তাদের কবর দেয়া হয়।
তিতাস উপজেলার বাতাকান্দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের একটি যুদ্ধ হয়। ২০শে নভেম্বরের এ যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হয়ে লঞ্চযোগে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। তবে হোমনা উপজেলার মনির হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া এখানে আরো কয়েকটি ছোটখাটো অপারেশন পরিচালিত হয়। ৯ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
তিতাস উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবুল কাশেম (পিতা মনিরুল হক শিকদার, দক্ষিণ আকালিয়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের এমএসসি শেষ বর্ষের ছাত্র), লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ (কড়িকান্দি), ক্যাপ্টেন এ কে এম নুরুল আবসার (মজিদপুর), শাহ আলম (কড়িকান্দি), রফিকুল ইসলাম (কড়িকান্দি), নায়েক আবদুর রহমান (চররাজাপুর), ডা. সিরাজুল ইসলাম (নাগেরচর), হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া (ঐচারচর) এবং ডা. আবদুল লতিফ সরকার (বেপারী খলিলাবাদ)। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে দাউদকান্দি ও হোমনা উপজেলার কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ২রা নভেম্বর রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা তাঁকে আটক করে এবং প্রায় একমাস নির্যাতনের পর ২রা ডিসেম্বর কসবার কোল্লাপাথর এলাকায় হত্যা করে তাঁর লাশ সালদা নদীতে ফেলে দেয়। পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম লাশটি তুলে আরো ৫৩ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাঁকে দাফন করেন এবং প্রত্যেকের সমাধিতে নাম-ঠিকানা লিখে রাখেন।
শহীদ ক্যাপ্টেন এ কে এম নুরুল আবসারের নামে মজিদপুর সড়কের নামকরণ করা হয়। [আবদুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড