মুক্তিযুদ্ধে তানোর উপজেলা (রাজশাহী)
তানোর উপজেলা (রাজশাহী) রাজশাহী জেলা শহর থেকে ৫০ কিমি দূরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত। বেশির ভাগ ছিল কাঁচা রাস্তা। এছাড়া প্রচুর খাল, ডোবা ও নদী থাকায় পাকবাহিনীর চলাচলের জন্য এ অঞ্চল সুবিধাজনক ছিল না। পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তা ছিল খুবই সহায়ক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। নির্বাচনের পর পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু এবং ৭ই মার্চ তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানালে তানোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন সাগারাম মাঝি। এছাড়া শুকলাল মুর্মু, চাম্পাই সরেন, কমরেড এরাদ, মতিউর রহমান প্রমুখ সংগঠক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মার্চ মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধা এলেম উদ্দিন ও আবদুল ওয়াহাবসহ কয়েকজন মিলে কামারগাঁতে অবস্থিত তানোর ও মোহনপুরের রাজস্ব অফিসের পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে পদ্মা নদী পার হয়ে খিদিরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মালদা জেলার ভগবানগোলা, বহরমপুর হাতিনগর শরণার্থী ক্যাম্প ও গৌড়বাগান ইয়ুথ ক্যাম্পে গমন করেন। এ ছাড়া তারা শিলিগুড়ির পানিঘাটা ট্রেনিং সেন্টারেও প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধাদের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, এলএমজি, এসএমজি, এসএলআর, মার্ক-ফোর ইত্যাদি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তানোর উপজেলার যুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন শফিকুর রহমান রাজা (আলুপট্টি, রাজশাহী) এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন অভয়পদ ওঁরাও (গোদাগাড়ির ভাজনপুর) ও বিশ্বনাথ টুডু।
এপ্রিল মাসে পাকবাহিনী তানোরে অনুপ্রবেশ করে এবং তানোর থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। উপজেলার পাচন্দর (কোচাপুকুর), বাগধানী, তালোন্দোর রাজবাড়ি ও মুন্ডুমালায় রাজাকারদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
তানোর উপজেলায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর তৎপরতা ছিল। শীর্ষস্থানীয় রাজাকার ছিল পাচন্দরের রেজাতুল্লাহ সরকার, বাগধানীর ভিকু, কালিগঞ্জের আইয়ুব চেয়ারম্যান, সৈয়দ আলী মিয়া, সৈয়দ আলী সোনার ও আবেদ আলী সোনার। আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল শামসুদ্দিন। পাকবাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকাররা চান্দুরিয়া গ্রামের হারুন অর রশিদ ওরফে হারাধন এবং তার দুই পুত্র রহমত আলী ও মমিন উদ্দিনকে হত্যা করে। এরপর তারা জনৈক গাড়োয়ানকে (গরুর গাড়ির চালক) হত্যা করে। রাজাকাররা আবদুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তিকে তার বাড়ি থেকে ধরে মুণ্ডুমালার রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে হত্যা করে লাশ পুঁতে রাখে। এভাবে বহু লোককে রাজাকার ক্যাম্পে ধরে এনে হত্যা করা হয়। ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে নৌকায় করে মোহনপুর রাজাকার ক্যাম্পে এনে হত্যা করা হয়, যা মোহনপুর গণহত্যা নামে পরিচিত বিলকুমারী বিলেও অনেককে তারা এভাবে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দি করে পানিতে ডুবিয়ে দেয়। বাগধানী ক্যাম্পের রাজাকাররা পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মেয়েদেরকে ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন চালাত। মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যাম্প রেইড করার সময় ৫টি মেয়ের মৃতদেহ দেখতে পান। পাকবাহিনী চৌবাড়িয়া হাটে অগ্নিসংযোগ করে হাটটি সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়িসহ সাধারণ জনগণের ঘরবাড়িতে ব্যাপকভাবে লুণ্ঠন চালিয়ে পরে সেসব ধ্বংস করে দেয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তারা স্থানীয় গির্জার সব দরজা ও জানালা খুলে নেয়। এছাড়া তারা বহু গরু, মহিষ, ভেড়া ও মূল্যবান গাছ লুট করে নিয়ে যায়। তানোর থানা ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এছাড়া তালোন্দোর জমিদার বাড়ি নারীনির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
কামারগাঁয়ের দৈলাপুকুরে ৫০ জন মানুষকে গণকবর দেয়া হয়, যা দৈলাপুকুর গণকবর নামে পরিচিত। তালোন্দোর তাঁতিয়া কুড়িতে ১০ জন মানুষের একটি গণকবর রয়েছে, যা তাঁতিয়া কুড়ি গণকবর হিসেবে পরিচিত।
১৭ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বাগধানী রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন করেন। এতে ক্যাম্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন সারোয়ার হোসেন বাবলা, মতিনউদ্দিন, আমিনুল হক টুকু ও ওলিউল ইসলাম। বাগধানী ক্যাম্প থেকে ব্রিটেন নির্মিত ২টি স্টেনগান, ১৬টি ৩০৩ রাইফেল, ৪টি মার্কস-৪ রাইফেল ও একটি কারবাইন উদ্ধার করা হয়। ১৮ ও ১৯শে নভেম্বর মকবুল হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাগধানী ব্রিজে পাহারারত রাজাকার ও মিলিশিয়াদের ওপর আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পানসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং বাকিরা পিছু হটেন। এটি বাগধানী ব্রিজ অপারেশন হিসেবে পরিচিত। কমান্ডার শফিকুর রহমান রাজার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তানোর থানায় অবস্থানরত পাকসেনা ও তাদের দোসরদের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। তানোর থানা অপারেশন-এ ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। এ-যুদ্ধে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। তানোরে অবস্থিত তালোন্দো রাজবাড়ি ছিল রাজাকারদের একটি শক্তিশালী ক্যাম্প। এলেম উদ্দিন, আবদুল ওয়াহাব, আবদুস সামাদ ও নুরুল ইসলামসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এবং নওগাঁর আত্রাই এলাকার বামপন্থী নেতা ওহিদুর রহমানের বাহিনী সম্মিলিতভাবে ১২ই নভেম্বর এ ক্যাম্প আক্রমণ করে। রাজাকাররাও পাল্টা আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে রাজাকাররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। এটি তালোন্দো রাজবাড়ি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন হিসেবে পরিচিত। ১৪ই আগস্ট তানোর বাতাশপুর রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয়। এতে ১ জন রাজাকার নিহত হয়, ১৪ জন আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। ১৩ই ডিসেম্বর তানোর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
তানোরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোনায়েম মঞ্জুর (রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক), নুরুল ইসলাম (হরিয়ান), হাবিবুল্লাহ (হাবিব নগর) ও একজন আদিবাসীর সন্তান।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে তানোর এ কে সরকারি ডিগ্রি কলেজে একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। এটি উন্মোচন করেন এক শহীদের জননী মোসা. সালেহা খাতুন। [মো. মনিরুল হক লেনিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড