মুক্তিযুদ্ধে তাড়াইল উপজেলা
তাড়াইল উপজেলা (কিশোরগঞ্জ) মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন একটি থানা। জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ২৫ কিমি। তখন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল পায়েচলা পথ এবং নীলগঞ্জ থেকে নৌপথ। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাঙালিদের মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে সেদিন প্রকারান্তরে ঘোষিত হয় বাঙালিদের একমাত্র দাবি স্বাধীনতা। পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে তাঁর সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে দেশব্যাপী শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। এ-যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে তাড়াইল উপজেলায় গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি র নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ৯ সদস্যবিশিষ্ট এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন আবুল কাশেম ভূঁইয়া (মাগুরী; থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি) এবং সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া (আওয়ামী লীগ)। ছাত্রনেতা আবুল কাশেম সালতু (পরে মুজিব বাহিনী-র সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), নূরুল হক লাল মিয়া (সাচাইল), আব্দুল হাই, আব্দুল জব্বার নওয়াব, মো. শাহাবুদ্দিন, মো. আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া, মো. ছলিম উদ্দিন (পরে মুজিব বাহিনীর সদস্য), খলিলুর রহমান, ফজলুর রহমান প্রমুখকে নিয়ে থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই শিমুলআঁটি গ্রামের মনফর আলী ভূঞা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুবেদার মেজর পদ ছেড়ে স্বদেশের মুক্তির পক্ষে অবস্থান নেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর তিনি তাড়াইল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় তরুণদের প্যারেড করাতে থাকেন। এভাবে বেসামরিক লোকদের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধে তাড়াইল উপজেলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে আবুল কাশেম ভূঁইয়া, আব্দুল হামিদ (বানাইল; সাধারণ সম্পাদক, থানা আওয়ামী লীগ), গঙ্গেশ সরকার (দামিহা মোজাফফর ন্যাপ) এবং আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া (পংপাচিহা; কমিউনিস্ট পার্টি)র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আরো ছিলেন- আওয়ামী লীগের জয়নাল আবেদিন রঙ্গু মিয়া (সাচাইল), নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া (জাওয়ার), সৈয়দ আব্দুল মান্নান (সেকান্দরনগর), আব্দুল খালেক খান (তালজাঙ্গা), আমির উদ্দিন মাস্টার (দিগদাইর), ডা. আব্দুল আজিজ (রাউতি) ও সত্যেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক (তাড়াইল বাজার); ন্যাপ (মোজাফফর) নেতাদের মধ্যে ছিলেন হাফিজ উদ্দিন (তাড়াইল বাজার), আব্দুল মজিদ দুখু (সাচাইল), শামছুদ্দিন ভূঞা (পংপাচিহা), শামসুদ্দিন (গজেন্দ্রপুর ও আব্দুল আলী সরকার (বেলংকা)। এডভোকেট আমিরুল ইসলাম (তালজাঙ্গা), ফেরসুদ মিয়া (সেকান্দরনগর), মরতুজ আলী (কাজলা), সুলতান উদ্দিন (বরুহা), মুসলেহ উদ্দিন (কাজলা), আব্দুল হাই (কাজলা), দেবেন্দ্র চন্দ্র পাল (কাজলা), ছমির উদ্দিন ভূঞা (রাউতি), আবু জাহেদ ভূঞা (নগরকূল), আছাদুর রহমান খান ওরফে সোনা মিঞা (পুরুড়া), নূরুল হক লাল মিয়া এবং ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন (কাজলা)-এর নামও উল্লেখযোগ্য।
২০শে এপ্রিল পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জ মহকুমা সদর থেকে তাড়াইল থানা সদরে প্রবেশ করে ত্রাস সৃষ্টি করে এবং দুদিন পরে আবার কিশোরগঞ্জ ফিরে যায়। ২৩শে এপ্রিল তারা পুনরায় প্রবেশ করলে স্থানীয় দালালেরা তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এবং হানাদার বাহিনী তাড়াইল উচ্চ বিদ্যালয়, থানা ভবন ও ডাকবাংলো ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে।
তাড়াইল উপজেলায় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)র নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে দলীয়ভাবে মুসলিম লীগের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে ঘৃণিত। এ-সকল দলের নেতারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে হানাদার বাহিনীকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও নারীনির্যাতনে সহায়তা করে। এদের সহায়তায় গঠিত হয় শান্তি কমিটি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। রাজাকার বাহিনী তাড়াইল বাজারের সাদত ভিলা ও তাড়াইল থানা কোয়ার্টার্সে অবস্থান নেয়। তাড়াইল উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে এডভোকেট জহিরুল হক (ধলা, আলবদর কমান্ডার), আলী মুর্তুজা (ছনাটি, আলশামস কমান্ডার), চেয়ারম্যান মমতাজ উদ্দিন আকন্দ (দিগদাইর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির প্রধান), আব্দুল হেকিম মুন্সী (সহিলাটি, কুখ্যাত দালাল), আব্দুল গফুর মুন্সী (নগরকূল, কুখ্যাত দালাল ও রাজাকার), সুন্দর আলী (জাওয়ার, রাজাকার), আব্দুল ওয়াহাব (ছনাটি, রাজাকার) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
২০শে এপ্রিল তাড়াইল বাজারে প্রবেশ করে পাকবাহিনী অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে প্রাণ হারান বাজারের ব্যবসায়ী নীহার রঞ্জন পাল (পিতা লোকনাথ পাল, সাচাইল)। পাকিস্তানি দালাল, রাজাকার ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিরা হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নগরকূল, দামিহা, কাজলা, বেলংকা, ছনাটি, জাওয়ার, সাচাইল, শিমুলআঁটি, কোণাভাওয়াল, রাউতি, পংপাচিহা, ধলা, সেকান্দরনগরসহ তাড়াইলের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করে। যাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করা হয়, তারা হলেন- চণ্ডীচরণ তালুকদার (শিমুলআঁটি), নীরু ডাক্তার (শিমুলআঁটি), অমূল্য পাল (শিমুলআঁটি), অক্রোর পাল (শিমুলআঁটি), আব্দুল বেপারী (পশ্চিম সাচাইল), কুলীন বিহারী পাল (ধলা পালবাড়ি), ননী গোপাল পাল (ধলা পালবাড়ি), মুকুন্দ পাল (নগরকূল), তারা সুন্দরী (নগরকূল), অমূল্য ভূষণ পাল (নগরকূল), জগদ্বন্ধু পাল (নগরকূল), মহেন্দ্ৰ পাল (নগরকূল), বৈকুণ্ঠ পাল (নগরকূল), হাছান আহমেদ ওরফে হাছু বেপারী (পূর্ব সাচাইল), নূরুল ইসলাম ভূঞা (পশ্চিম জাওয়ার), আব্দুর রউব (পূর্ব জাওয়ার), মনোরঞ্জন চক্রবর্তী (হালুয়াপাড়া), লুৎফুর রহমান (করাতি), আমির আলী খান বাচ্চু (করাতি), আব্দুল কাদির ভূঞা (করাতি) এবং নূরুল ইসলাম ভূঞা (পূর্ব জাওয়ার)।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এ-সময় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কয়েকজনকে হত্যা এবং একাধিক যুবতী নারীকে পাশবিক নির্যাতন করে। বিশেষকরে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম দামিহা, নগরকূল ও শিমুলআঁটিতে চরম নৃশংসতা চালায়। হানাদার বাহিনী কর্তৃক তাড়াইলের দামিহার সরলা বর্মণ শৈল, বাসন্তী বর্মণ, তাড়াইল বাজারের অপর এক হিন্দু নারী এবং নগরকুলের ৮ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। শেষোক্ত ৮ জনকে ইটনা থানার পাক ক্যাম্পে আটকে রেখে তিনদিন যাবৎ ধর্ষণ করা হয়। পরে নগরকুলের কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল গফুর মুন্সী ও তার ছেলে আশরাফ মুন্সীর মাধ্যমে তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়। কিশোরগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিনের পুত্র রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মুহম্মদ হাসান তাড়াইল থানায় অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তাড়াইল উপজেলায় চারটি গণহত্যার ঘটনা ঘটায়। সেগুলো হলো— নগরকূল গণহত্যা, দামিহা গণহত্য, শিমুলআঁটি গণহত্যা এবং বেলংকা গণহত্যা। এপ্রিল মাসে নগরকূল গ্রামের ১৭ জন নারী-পুরুষকে হানাদাররা ধরে নিয়ে কিশোরগঞ্জ সদরের সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাট এলাকায় হত্যা করে, যা নগরকূল গণহত্যা নামে পরিচিত। জুন মাসের প্রথম দিকে সংঘটিত দামিহা গণহত্যায় ১৪ জন, সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সংঘটিত শিমুলআঁটি গণহত্যায় ১৩ জন এবং ১৬ই নভেম্বর সংঘটিত বেলংকা গণহত্যায় ৮ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরো ১৯ জনকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন- শামসুদ্দিন আহম্মেদ (পিতা মো. সিরাজুল ইসলাম, সাচাইল), মো. আব্দুর রশিদ (পিতা আব্দুল হামিদ ব্যাপারী, পশ্চিম সাচাইল), মনোরঞ্জন চক্রবর্তী (পিতা ক্ষেত্রমোহন চক্রবর্তী, সেকান্দরনগর), কামিনী কুমার ঘোষ (পিতা রাজময় ঘোষ, আড়াইউড়া), জীবন কৃষ্ণ চক্রবর্তী ওরফে জীবন ঠাকুর (পিতা শৈলেশ চন্দ্ৰ চক্রবর্তী, আড়াইউড়া), মো. চান মিয়া (পিতা ভোলা মিয়া, দিগদাইর), সত্যেন্দ্র তরফদার (পিতা হেমেন্দ্র তরফদার, ছনাটি), কৃষ্ণদাস বণিক (পিতা প্রভাত চন্দ্র বণিক, ছনাটি; কটিয়াদীতে শহীদ), মো. সোলেমান (পিতা আবুল হোসেন, হাতকাজলা), মকসুদ আলী (পিতা অজর উদ্দিন, হাতকাজলা), লোবান মিয়া (পিতা উমেদ আলী, হাতকাজলা), মো. বুধু মিয়া (পিতা আনফর মিয়া, ভাদেরা), সুরেন্দ্র বিশ্বাস (পিতা রায়চাঁদ বিশ্বাস, ভাদেরা), যোগেশ চন্দ্র সরকার (পিতা কাশুর চন্দ্র সরকার, দক্ষিণ নগর), নরেন্দ্র (পিতা জলধর, দিগদাইর), তোফাজ্জল হোসেন ভূঞা ওরফে লালু ভূঞা (পিতা আব্দুল হোসেন ভূঞা, ভাওয়াল), যোগেন্দ্ৰ কর্মকার (বিরি জাওয়ার), সিরিস কর্মকার (বিরি জাওয়ার) এবং ইটনা গল্লি থেকে আগত একজন অতিথি।
তাড়াইল থানা ক্যাম্প এবং নগরকুল গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল গফুর মুন্সীর বাড়ি ছিল হানাদার বাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতন করে দূরে কোথাও নিয়ে হত্যা করা হতো।
তাড়াইল উপজেলায় দুটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে— বেলংকা বটতলা বধ্যভূমি এবং নরসুন্দা নদীতীর বধ্যভূমি। এ-দুটি স্থানে প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশকিছু লোককে হত্যা করা হয়।
তাড়াইল থানায় পাক হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনবার যুদ্ধ হয়, যা তাড়াইল থানাযুদ্ধ নামে পরিচিত। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করেন। নভেম্বর মাসের শেষদিকে হানাদাররা আবার তা দখল করে নেয়। ১৪ই ডিসম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় দখল করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন এবং এদিনই তাড়াইল উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, বীর প্রতীক- (পিতা মুন্সি আব্দুল গনি, কাজলা)।
তাড়াইল উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. মতিউর রহমান ভূঁইয়া (পিতা আব্দুল হাফিজ ভূঁইয়া, শিমুলআঁটি), আব্দুস সালাম (পিতা আব্দুস সোবাহান, আকবপুর), রতন পাল (পিতা নীহার রঞ্জন পাল, ভেইয়ারকোণা), অনোয়ার হোসেন (অষ্টগ্রাম) ও মো. ইদ্রিস আলী (পিতা শরিয়ত আলী, সেরুয়াকান্দা)।
তাড়াইল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাড়াইল মুক্তিযোদ্ধা ডিগ্রি কলেজ। এ কলেজে একটি মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া দড়িজাহাঙ্গীরপুর গ্রামে একটি বাজারের নামকরণ করা হয়েছে জয়বাংলা বাজার। [ছাদেকুর রহমান রতন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড