ঢালা-ছত্রিশ গণহত্যা (মিটামইন, কিশোরগঞ্জ)
ঢালা-ছত্রিশ গণহত্যা (মিটামইন, কিশোরগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৫ই সেপ্টেম্বর। এতে দুশতাধিক লোক নিহত হয়।
কিশোরগঞ্জ জেলার মিটামইন উপজেলার অন্তর্গত কাটখাল ইউনিয়নের একটি গ্রাম ঢালা-ছত্রিশ। ১৯৭১ সালে এ গ্রামের বাসিন্দাদের সবাই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কৃষি এবং মাছ ধরা ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। মিটামইন সদর থেকে গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিমি। ইটনা উপজেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ১০ কিমি৷
ঢালা-ছত্রিশ হাওরের মধ্যে অবস্থিত একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম। রাজনীতির সঙ্গে এ গ্রামের মানুষের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এজন্য পাকিস্তানিদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ারও কোনো ভয় তাদের ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সুযোগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিছু লোক এ গ্রামে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালায়। পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে ছিল কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের কুখ্যাত দালাল আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া (কুরবান আলী), তার পিতা সাহেব আলী ভূঁইয়া, তার ছেলে আব্দুল হক ভূঁইয়া, ভগ্নিপতি আবু তাহের, মতি মিয়া, ঘাগড়ার ইদ্রিছ মৌলানা, কাটখাল ইউনিয়নের খুর্শেদ, ঢাকী ইউনিয়নের সামসু মৌলভী প্রমুখ। গ্রামে মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়স্থল রয়েছে বলে তারা ইটনা থানা থেকে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের ঢালা-ছত্রিশে নিয়ে আসে।
১৫ই সেপ্টেম্বর কয়েকটি বড় নৌকা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ঢালা-ছত্রিশ গ্রামে পৌছে। তারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। নারী-পুরুষ-শিশু-সহ দুই শতাধিক গ্রামবাসী পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে বন্দি হয়। এর মধ্যে রাজাকার আ. মান্নান ভূঁইয়ার সহযোগীরা গ্রামটিতে লুণ্ঠন চালায়। তারা বন্দিদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকার ও টাকা- পয়সা ছিনিয়ে নেয়। অনেক বাড়ি থেকে ধান, চাল, গরু, মহিষ-সহ সকল মূল্যবান জিনিস লুট করে নেয়। বন্দিদের হাত বেঁধে নৌকায় উঠিয়ে পুরো গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপরের ঘটনা ছিল আরো বর্বরোচিত ও লোমহর্ষক। ইতিহাসে এমন বর্বরতা বিরল। দুই শতাধিক নারী- পুরুষকে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকাররা ইটনা থানার জয়সিদ্দি ইউনিয়নের বয়রা গ্রামে আসে। সেখানে একটি বটগাছের নিচে তাদের নামিয়ে বেয়নেটের আঘাতে একজন-একজন করে হত্যা করে। বৃদ্ধ ও শিশুরাও বর্বরদের হাত থেকে নিস্তার পায়নি। নরপশুরা শুধু অল্প বয়স্ক মেয়েদের তাদের ঘৃণ্য লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য রেখে দেয়। ইটনা ক্যাম্প থেকে পরে অনেক নারীকে কিশোরগঞ্জ, নিকলী এবং নান্দাইল পাকক্যাম্পে পাঠানো হয়। দিনের পর দিন নির্যাতিত এসব নারী সব হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়।
ঢালা-ছত্রিশ গ্রামের সকল শহীদের তালিকা সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- ক্ষেত্রমোহন চৌধুরী (পিতা হৃদয় চৌধুরী), ধীরেন্দ্র চৌধুরী (পিতা হৃদয় চৌধুরী), কামিনী চৌধুরী (পিতা হৃদয় চৌধুরী), ভোতা চৌধুরী (পিতা ধীরেন্দ্র চৌধুরী), মোরারী চৌধুরী (পিতা মনা চৌধুরী), পর্তিক চৌধুরী (পিতা রাজকুমার চৌধুরী), বভিরল চৌধুরী (পিতা রাজকুমার চৌধুরী), রমেশ চৌধুরী (পিতা গোবিন্দ চৌধুরী), মুকুন্দ চৌধুরী (পিতা গোবিন্দ চৌধুরী), প্রাণেশ চৌধুরী (পিতা গোবিন্দ চৌধুরী), জয়দেব চৌধুরী (পিতা কিলপিল চৌধুরী), জয়দেব চৌধুরী (পিতা কিলপিল চৌধুরী), কার্তিক দাস (পিতা ভীম দাস), মগন দাস (পিতা ভীম দাস), মগ্না দাস (পিতা অর্জুন দাস), কালাচান দাস (পিতা রামকান্ত দাস), ধনঞ্জয় দাস (পিতা ধুহাই দাস), প্রেমচরণ দাস, জুদেব দাস, বাতাস চন্দ্র দাস প্রমুখ। [শেখ অলিনেওয়াজ অলিউল্লাহ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড