মুক্তিযুদ্ধে জুড়ী উপজেলা (মৌলভীবাজার)
জুড়ী উপজেলা (মৌলভীবাজার) একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা। এর দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা এবং পূর্বে ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্য। ১৯৭১ সালে জুড়ী ছিল বড়লেখা থানার অধীন।
১৯৭০ সালে কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলার যৌথ নির্বাচনী সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। তাঁর আগমন ও ভাষণে এলাকায় আওয়ামী লীগ-এর পক্ষে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। বড়লেখা (জুড়ী) এবং কুলাউড়ার বরমচাল ভাটেরা ও ভুকশিমইল এলাকা নিয়ে একটি নির্বাচনী আসন ছিল। মো. তাইমুছ আলী এ আসন থেকে এমপিএ নির্বাচিত হন। রাজনৈতিকভাবে জুড়ী আগে থেকেই রাজনীতি-সচেতন এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। একাত্তরের মার্চে সারাদেশের মতো জুড়ীর মানুষও অসহযোগ আন্দোলন-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তাইমুছ আলী এমপিএ ৪০ জন মুজাহিদ সদস্যকে নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনী ‘তাইমুছ বাহিনী’ নামে পরিচিতি পায়। ফেব্রুয়ারিতেই তিনি এ বাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। তাইমুছ আলী জুড়ীতে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু করেন। জুড়ী ফুলতলা, গোয়ালবাড়ি, সাগরনাল ও জুড়ী ভেলির ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদ বাহিনীর কয়েকজন প্রাক্তন সৈনিক ছিলেন। জুড়ীর অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
তাইমুছ আলী এমপিএ এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ও তাইমুছ বাহিনীর প্রধান ছিলেন। জুড়ীর দ্বিতীয় প্রধান সংগঠক ছিলেন জুড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল খালিক চৌধুরী (খালিক মিয়া)। অন্য সংগঠকরা হলেন- ডা. কুমুদ রঞ্জন দে, রকীব আলী চৌধুরী, তৈয়ব আলী, শফিক আহমদ, রওয়াব আলী, বশির আহমদ মেম্বার, মতছিন আলী মেম্বার, মহরম আলী, এম এ জলিল মাসুক, এম এ মুমিত আসুক, বদরুল হোসেন বদরুল, রকিব আহদ, তজম্মুল আলী, আজির উদ্দিন, মজম্মিল আলী, শাহজাহান মিয়া, সিরাজুল ইসলাম মেম্বার, আকদ্দছ আলী তালুকদার, জমির আলী ও আবদুল গনি। ছাত্র-যুবকদের মধ্যে হাদী হোসেন বাবুল, এম এ মোহাইমিন সালেহ, অপূর্ব কান্তি ধর, শ্রীমন্ত রায় চৌধুরী, কুলেশ চন্দ্র চন্দ, নজমূল ইসলাম মাস্টার, বশারত আলী, কন্দর্প দে, আবদুল বশির, বাবুল খা, মরতুজা আলী, ছাবিদ আলী, কামরুজ্জামান (চান মিয়া) প্রমুখ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
জুড়ীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে দুটি বাহিনীর কার্যক্রম ছিল। একটির কার্যক্রম প্রকাশ্যে ছিল, যা তাইমুছ বাহিনী নামে পরিচিত। অপরটি ছিল গোপন বা আন্ডারগ্রাউন্ডে। এটির নাম ছিল মন্ত বাহিনী। শ্রীমন্ত রায় চৌধুরী বামপন্থীদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করেন। এলাকায় মন্ত বাহিনীর স্বল্প পরিচিতি ছিল। ৭ই মে জুড়ী শত্রুবাহিনীর হাতে চলে যাবার পর তাইমুছ আলী তাঁর বাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিয়ে ভারতের কৈলাশহরে যান। প্রথমে তাঁদের থানায় আটক করে রাখা হয়। পরে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে তাঁরা বাঘনা রানীবাড়ি এলাকায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করে সেখান থেকে ফুলতলা, সাগরনাল প্রভৃতি এলাকায় কয়েকটি গেরিলা হামলা পরিচালনা করেন। এক সময় তাইমুছ আলী জেনারেল ওসমানীর চাপে তাঁর বাহিনীর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন এবং ধর্মনগর যুব ক্যাম্পের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওসমানী রাঘনা রানীবাড়ি ক্যাম্প থেকে অত্র অঞ্চলে তাইমুছ বাহিনীর সদস্যদের যুদ্ধ পরিচালনার অনুমতি দিয়ে এম এ মুমিত আসুককে অধিনায়ক ও এম এ জলিল মাসুককে উপ-অধিনায়ক নিয়োগ দেন। তবে ৪নং সেক্টরের অধীনস্থ সাবসেক্টর হিসেবে এর অনুমোদন চূড়ান্ত করেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে লেখা ইতিহাসে রাঘনা রানীবাড়ি ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন এম এ মুমিত আসুক ও ক্যাপ্টেন এম এ জলিল মাসুকের নেতৃত্বে এ এলাকায় যুদ্ধ পরিচালিত হয় বলে উল্লিখিত রয়েছে।
ষাটের দশক থেকে হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার সুনীল লৌহ, কুলাউড়ার সৈয়দ আকমল হোসেন (বিদ্রোহী সৈয়দ), সিলেটের পবণ চন্দ্র দেবনাথ, মফিজ আলী, কমলগঞ্জের লালকালির কবি আবু কায়সার খান, শ্রীমন্ত রায় চৌধুরী প্রমুখ গোপন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হাওড় কড়াইয়ার কৃষক
আন্দোলন ও ধামাই চা-বাগানের ১৪ দিনের কর্মবিরতি অত্র অঞ্চলে তাঁদের সফল কর্মসূচি ছিল। লোহারবন্দে ডা. তজমূল আলী, মখলিস উদ্দিন ও শ্রীমন্ত রায় চৌধুরীর প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলে তাঁরা কমলপুর সাবসেক্টরে যুক্ত হন। এখান থেকে সুবেদার মঞ্জুরের সহাযোগিতায় শ্রীমন্ত রায় চৌধুরী ও মখলিস কিছু অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে মন্ত্রীগাও-এর ভেতর চলে আসেন। তাঁরা দিনে আত্মগোপন এবং রাতে জনযোদ্ধা সংগ্রহ করে ভারতে প্রশিক্ষণ দিয়ে কখনো শিলুয়া চা-বাগান, কখনো গোয়ালবাড়ী, কখনো জুড়ীতে ঝটিকা হামলা করতে থাকেন। এ বাহিনী জুড়ী বাজার ও শিলুয়া চা- বাগানের ফ্যাক্টরিতে দুটি দুঃসাহসী হামলা পরিচালনা করে।
তাইমুছ বাহিনী শেরপুরের প্রতিরোধযুদ্ধ ও হেতিমগঞ্জ যুদ্ধে অংশ নেয়। ২৯শে মার্চ তাইমুছ আলী এমপিএ তাঁর বাহিনী নিয়ে মৌলভীবাজার যান। বাহিনীর সদস্যদের ডাকবাংলোয় রাখা হয়। সি আর দত্ত (পরে সেক্টর কমান্ডার) ও কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী (হবিগঞ্জের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক)-র সঙ্গে মিলে ৪ঠা এপ্রিল তাইমুছ আলী তাঁর বাহিনী নিয়ে শেরপুরের ঐতিহাসিক প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। এ-যুদ্ধে জুড়ীর রকীব আলী শহীদ হন। তিনি জুড়ীর প্রথম শহীদ। এরপর তাঁর সেকেন্ড- -ইন-ব ন-কমান্ড এম এ জলিল মাসুক, এম এ মুমিত আসুক প্রমুখকে তিনি হেতিমগঞ্জ প্রতিরোধযুদ্ধে পাঠান। সেখানে আবদুর রহীম চৌধুরী শহীদ হন। তিনি জুড়ীর দ্বিতীয় শহীদ।
পাকবাহিনী জুড়ী উপজেলায় ৭ই মে প্রথম অনুপ্রবেশ করে। তারা জুড়ীতে জনতা ব্যাংক সংলগ্ন সিকান্দর আলীর দোতলা বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। জুড়ী হাইস্কুলের একটি ভবনকেও পাকবাহিনী ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করে। জুড়ীভ্যালি ক্লাব ও ডাকবাংলোতে আরেকটি ক্যাম্প করে। এছাড়া মুসলিম লীগ নেতা হাজী আপ্তাব উদ্দিন আহমদের জুড়ীস্থ বাসভবন, শিলুয়া চা-বাগান, ফুলতলা চা-বাগান, ফুলতলা বাজার, সাগরনাল চা-বাগান, লাঠিটিলা বিওপি, সোনারূপা চা-বাগান, দিলখুশ চা-বাগান, মানিক সিংহ বাজার প্রভৃতি স্থানে তাদের ক্যাম্প ছিল।
জুড়ীতে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ বেশ সক্রিয় ছিল। মুসলিম লীগের নেতাদের নেতৃত্বে এখানে শান্তি কমিটি – ও -রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। জুড়ীর শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের মধ্যে ছিল- হাজী আপ্তাব উদ্দিন আহমদ গোয়ালবাড়ী; মুসলিম লীগের জুড়ী-বড়লেখা আঞ্চলিক ও থানা সভাপতি; বড়লেখা-জুড়ী শূন্য আসনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত), আবদুল মোক্তাদির চৌধুরী (ভবানীপুর; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক), ইউছুফ আলী সরপঞ্চ (কামিনী বাজার; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক), ফৈয়াজ উদ্দিন চৌধুরী (স্টেশন রোড; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক), রইছ আলী (ভজির টিলা; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য), বশির উদ্দিন আহমদ (চেয়ারম্যান, গোয়ালবাড়ী ইউপি; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য), আবদুল ওয়াহেদ ময়না মিয়া (বেলাগাও; জায়ফর নগর ইউপি-র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য), চেরাগ মিয়া (ভবানীপুর; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য), রকীব আলী চেয়ারম্যান (ভোকতেরা; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য), মর্তুজ আলী মেম্বার (জায়ফর নগর; মুসলিম লীগ নেতা), হাজী ইনজাদ আলী (গোয়ালবাড়ী; মুসলিম লীগ নেতা), মৌলভী সুয়াইব আলী (জায়ফর নগর; শান্তি কমিটির নেতা), হাজী মনোহর আলী মনু (গোয়ালবাড়ী; মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য), মজম্মিল আলী মজই মিয়া (গোবিন্দপুর; মুসলিম লীগ নেতা), আবদুল মতলিব পাখি (ভবানীপুর; রাজাকার বাহিনীর সংগঠক ও প্রধান), মোহাম্মদ তাওয়াকুল (হরিরামপুর; শীর্ষস্থানীয় রাজাকার সদস্য ও রাজাকার বাহিনীর সংগঠক), রজব আলী মাস্টার (বেলাগাও; মুসলিম লীগ নেতা), আবদুল বাকী (পশ্চিম বড়ধামাই; রাজাকার বাহিনীর সদস্য ও সংগঠক), হাজী মনোহর আলী ওরফে মনু মহাজন (কামিনীগঞ্জ বাজার; মুসলিম লীগ নেতা), হাজী সিকন্দর আলী (কামিনীগঞ্জ বাজার; মুসলিম লীগ নেতা), আবদুল লতিফ (দ্বহপাড়া; রাজাকার বাহিনীর সংগঠক ও সদস্য), টেনু মিয়া মাস্টার (ভোকতেরা; মুসলিম লীগ নেতা), আইয়ুব আলী স্বদেশী (পশ্চিম ভোকতেরা; মুসলিম লীগ নেতা), শান্তি কমিটির সদস্য তোতা মিয়া প্রমুখ। পরে আবদুল মোক্তাদির চৌধুরীকে শান্তি কমিটির আহ্বায়ক এবং ক্যাপ্টেন আবদুল মতলিব পাখিকে রাজাকার বাহিনীর প্রধান করা হয়। রাজাকার সদস্যদের মধ্যে তওয়াকুল, রহমত আলী, আবদুল লতিফ, ইসমাইল আলী টলই, মজম্মিল আলী, আবদুল বাকি, শামসুদ্দীন প্রমুখ খুবই দুর্ধর্ষ ছিল। এরা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন, হত্যা প্রভৃতি অপকর্মে লিপ্ত ছিল।
জুড়ীতে সিকান্দর আলীর বাড়িতে স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্পের পাশেই মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টেন এম এ জলিল মাসুক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিলেট জেলার যুগ্ম- আহ্বায়ক বদরুল হোসেনের বাড়ি ছিল। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে ভারত চলে যান। পাকবাহিনী প্রথমেই তাঁদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর পাতিলা সাঙ্গণের আবদুছ ছত্তারের বাড়িতে অগ্নিকাণ্ড ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। আবদুছ ছত্তার আনসার বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং ব্রিজ ধ্বংসের কাজে পারদর্শী ছিলেন। কাউলির পুল ধ্বংসের সঙ্গে আবদুছ ছত্তার সরাসরি জড়িত থাকায় রাজাকার আবদুল মতলিব পাখি, ইসমাইল আলী টলই, মজম্মিল আলী, আব্দুল বাকী, আব্দুল লতীফ প্রমুখ তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকাররা তাঁর পিতা জোয়াদ আলীকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে সোপর্দ করে। সেখানে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয়। রাজাকাররা পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের জামকান্দি গ্রামের ভিখুয়া মুণ্ডার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা ভিখুয়া মুণ্ডার ছেলে টুনি মুণ্ডাকে হত্যা করে।
জুড়ীর ন্যাপকর্মী মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ আহমেদকে ধরে নিয়ে পাকসেনারা অমানুষিক নির্যাতন করে এবং বিরগুয়ালি ঘাটে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। তিনি পানিতে ঝাঁপিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও গুরুতর আহত হন। পরদিন পাকহানাদাররা তাঁর অপ্রকৃতিস্থ ভাই কুটি মিয়া এবং আজিজুল হককে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা রাজাকারদের নিয়ে করুণা বাবুর বাড়িতে চড়াও হয়ে বৃদ্ধ সুরেন্দ্র কুমার দেবকে হত্যা করে। সাগরনাল ডাকঘরে পোস্ট-মাস্টার আবদুর রউফকে এবং কালিবাড়িতে নেসার আহমদকে হত্যা করে। খাগটেকা গ্রামে হত্যার শিকার হন রাজেন্দ্র দাশ ও রাজ কিশোর। এখানে পাকবাহিনীর নির্যাতনে আহত হন গীতা দাশ।
রাজাকার তওয়াকুল মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বশিরের বড়ভাই আবদুল গনিকে ধরে নিয়ে মানিক সিংহ ক্যাম্পে নির্যাতন করে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জমির আলীর পিতা লোকসাহিত্যিক আমির সাধুকে রাজাকার রহমত আলী পাকহানাদারদের চিনিয়ে দেয়। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও ঘোর সমর্থক ছিলেন। বৃদ্ধ আমির সাধুকে দিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প কমান্ডারের রিক্সা টানানো হতো। এতে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। জুড়ীতে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবিরগুলোর মধ্যে ছিল জুড়ী উচ্চ বিদ্যালয়, সিকন্দর মিয়ার বাড়ী, জুড়ীভ্যালি ক্লাব, ডাকবাংলো, মানিক সিংহ বাজার ক্যাম্প প্রভৃতি। এসব জায়গায় স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে বন্দি রেখে অমানুষিক নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। নারীদের ধরে আটকে রাখা ও ধর্ষণ করা হতো।
জুড়ীর বধ্যভূমির মধ্যে জনতা ব্যাংকের পেছনের এলাকা এবং জুড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিমের ডোবা ছিল প্রধান। রানী মুরার বিরগুয়ালি ঘাট, জুড়ীর কালিবাড়ি এবং খাগটেকাতে বধ্যভূমি রয়েছে। স্বাধীনতার পর জুড়ীর উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন ডোবায় জোয়াদ আলী এবং দক্ষিণ ভাগ আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুর রবের কংকাল চিহ্নিত করা হয়।
পাকবাহিনীর সঙ্গে জুড়ী অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে ধামাই চা-বাগান, লাঠিটিলা বিওপি, দিলখুশ চা-বাগান, শিলুয়া চা-বাগান, সাগরনাল চা-বাগান, ফুলতলা চা-বাগান, ফুলতলা বাজার ও জুড়ী বাজার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
১৯শে জুন সংঘটিত কুকিতল সাবসেক্টরের অন্তর্ভুক্ত লাঠিটিলা বিওপি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন এম এ রব। সহ- অধিনায়ক ছিলেন সফিক। এ-যুদ্ধে ২৯ বেলুচ রেজিমেন্টের ১ জন হাবিলদার ও ১ জন সিপাহি মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। লাঠিটিলা বিওপি যুদ্ধ-এ বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। এখান থেকে প্রচুর গোলা-বারুদ মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
দিলখুশ চা বাগান যুদ্ধ সংঘটিত হয় দু-দফায়- ১৭ ও ২০শে জুলাই। এ যুদ্ধস্থল কুকিল সাবসেক্টরের মুখোমুখি অবস্থিত ছিল। কুকিতল ৪নং সাবসেক্টরের সদরদপ্তর ছিল। প্রথম দফা অভিযানে অধিনায়কত্ব করেন ক্যাপ্টেন শরিফুল হক। এতে বশির উদ্দিন আহমদ, নূরুল ইসলাম টুনু, হেলাল আহমদ, আরফান উল্লাহ, খায়রুল আলম-সহ ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অপরদিকে ১৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন পথপ্রদর্শক শহীদ হন। ২০শে জুলাই আজিজুল হক পনির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নতুন করে দিলখুশ চা-বাগানে অভিযান পরিচালনা করে। এ-যুদ্ধে ৬ জন পাকহানাদার নিহত হয়। এ সময় প্রচুর গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। দুদিনে সংঘটিত দিলখুশ চা- বাগান যুদ্ধ এ এলাকার মুক্তিযুদ্ধে একটি বড় ঘটনা।
ধামাই চা-বাগান ফ্যাক্টরি আক্রমণ- সংঘটিত হয় ২০শে আগস্ট। এ-যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বারপুঞ্জি সাবসেক্টর অধিনায়ক লেফেটেন্যান্ট এমদাদ। সহ-অধিনায়ক ছিলেন মাখন রুদ্র পাল। ২০শে আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা ধামাই চা বাগানে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। পাকসেনারা পাল্টা জবাব দিলে দুপক্ষের মধ্যে তিন ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এখানে ২০ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। পাকহানাদাররা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে ধামাই চা-বাগান ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এখানে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তাঁদের প্রথমে মনিপুরি গাও-এ নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ভারতের বারপুঞ্জি সাবসেক্টর ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়।
কুকিল এলাকাধীন শিলুয়া চা-বাগান ফ্যাক্টরিতে আক্রমণের নেতৃত্ব দেন শ্রীমন্ত রায় চৌধুরী। সহ-অধিনায়ক ছিলেন মখলিস। এ-যুদ্ধে বেশকিছু স্থানীয় ছাত্র-যুবক অংশগ্রহণ করে। শিলুয়া বাগান যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুন নূর পাকহানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। জুড়ী ক্যাম্পে রাজাকার রইছ আলীর প্ররোচনায় তাঁকে পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। শেখ আবদুন নূর জুড়ীর তৃতীয় শহীদ।
সাগরনাল চা-বাগান যুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন রাঘনা রানীবাড়ি ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন এম এ মুমিত আসুক। সহযোদ্ধারা ছিলেন মতিউর রহমান ওরফে আব্দুল মতিন, আজির উদ্দিন আহমদ, গোলাম রব্বানী, লক্ষ্মীনারায়ণ চ্যাটার্জী, কুলেশ চন্দ্ৰ চন্দ (মন্টু স্যার), মুকুল দে প্রমুখ। এ-যুদ্ধে পাকহানাদারদের প্রচুর ক্ষতি হয় এবং চা-বাগান স্থানীয় জনতার রোষে পড়ে। ফুলতলা চা বাগান যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন এম এ জলিল মাসুক। এতে সহ-অধিনায়ক ছিলেন এম এ মুমিত আসুক। যুদ্ধে অংশ নেন দেবাশীষ মজুমদার, মতিউর রহমান ওরফে আব্দুল মতিন, মোবারক আহমদ, আজমল আলী, গৌরাঙ্গ দেব প্রমুখ। ৫৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা দলের অংশগ্রহণে ফুলতলা চা-বাগান যুদ্ধ-এ ৩০ জন পাকহানাদার নিহত হয়।
ফুলতলা বাজার যুদ্ধে অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন এম এ জলিল মাসুক। এতে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। প্লাটুন কমান্ডার আব্দুস ছাত্তার, আব্দুস কালাম, মুকুল দে, আব্দুল মতিন, অরুণ দে, কুলেশ চন্দ্র চন্দ এ-যুদ্ধে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেন। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এটি একটি বড় যুদ্ধ ছিল। এ যুদ্ধ ফুলতলা বাজার যুদ্ধ নামে পরিচিত। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়।
জুড়ী বাজারে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে কয়েকটি হামলা পরিচালনা করেন। জুলাই মাসের শেষে এমনই একটি অপারেশনের নেতৃত্ব দেন নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান।
যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দুটি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং তারা পালিয়ে যায়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড কটুই মনা শহীদ হন। এ যুদ্ধে অন্যানের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক, বাবু, খোকন প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধ – জুড়ী বাজার ভজির টিলা বাংকার অপারেশন নামে পরিচিত। ৬ই ডিসেম্বর ভোরে জুড়ী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এদিন পাকহানাদাররা তাদের দোসরদের পরিত্যাগ করে কুলাউড়ার দিকে পালিয়ে যায়।
জুড়ীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— রকীব আলী (পিতা হুছন আলী, পাতিলা সাঙ্গন), আবদুর রহীম চৌধুরী (পিতা আব্দুস সাত্তার চৌধুরী, বটনী ঘাট), শেখ আবদুন নূর (পিতা শেখ আসকর আলী, কালিনগর) ও সৈয়দ ফয়জুর রহমান (উত্তর বড়ড়হর)।
জুড়ীতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে যেসব প্রতিষ্ঠান ও স্মৃতিস্মারক নির্মিত হয়েছে, সেগুলো হলো— শহীদ আবদুর রহীম চৌধুরী প্রাথমিক বিদ্যালয় (বটনী ঘাট, সাগরনাল), শহীদ শেখ আবদুন নূর প্রাথমিক বিদ্যালয় (কালিনগর, জায়ফর নগর), শহীদ শেখ আবদুন নূর সড়ক এবং মুক্তিযোদ্ধা আবদুছ ছত্তার সড়ক (জুড়ী-ফুলতলা সড়কের ভজির টিলা থেকে কালিনগর-ভোকতেরা সংযোগ-সেতু পর্যন্ত)। [হাসনাইন সাজ্জাদী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড