জিনারদী যুদ্ধ (নরসিংদী সদর)
জিনারদী যুদ্ধ (নরসিংদী সদর) সংঘটিত হয় ১৩ই আগস্ট। এতে ২ জন পাকসেনা নিহত হয় ও ১৫ জন আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। জিনারদীর যুদ্ধ ছিল সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ওরফে ন্যাভাল সিরাজের এক দুঃসাহসিক অভিযান। জিনারদীতে ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকেই হানাদার বাহিনী আশপাশের এলাকাগুলোতে নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে থাকে।। মুক্তিবাহিনীর সন্ধান পাওয়ার জন্য একদিকে যেমন নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে, অন্যদিকে তেমনি মানুষের গরু-ছাগল ধরে এনে খেতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, তারা মহিলাদের ওপরও নজর দেয়। ফলে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এসব অত্যাচারের খবর ইউনিট কমান্ডার ন্যাভাল সিরাজের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি এর প্রতিকার খুঁজতে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি কমান্ডার মুহম্মদ ইমাম উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করেন।
১৩ই আগস্ট বেলা ১২টার দিকে সিরাজ উদ্দিন নেহাব হেডকোয়ার্টার্স থেকে মাত্র ৪ জন সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শিবপুরের ইব্রাহিম, নেহাবের সুলতান, ভাটপাড়ার মান্নান ও কালিগঞ্জের সমর কষ্টা। ন্যাভাল সিরাজ সঙ্গীদের নিয়ে জিনারদী রেল স্টেশনের কাছাকাছি একটি বাড়িতে আসেন। সেখান থেকে একজন লোক মারফত ক্যাম্পের আর্মিদের খবরাখবর নেন।
জিনারদীতে পাকবাহিনীর ক্যাম্পটি ছিল রেল স্টেশনের উত্তর পাশে বাজারের পূর্বদিকে। দক্ষিণে সামান্য খোলা জায়গা এবং এরপর রেল লাইন। পশ্চিমে বাজারের গলিপথ। পূর্বদিকে কোনো রাস্তা নেই। তবে একটি ডোবার পাশ দিয়ে কোনোরকমে যাওয়া যেত। ক্যাম্পের দক্ষিণে খোলা জায়গা থাকায় এবং পশ্চিম দিকে গলিপথ থাকায় এই দুই দিকেই আর্মিরা সব সময় সশস্ত্র পাহারায় থাকত।
বেলা তখন দুটা। ক্যাম্পের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে আর্মিদের দুজন সশস্ত্র হানাদার পাহারায় নিয়োজিত। অন্যরা দুপুরের খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক এমন সময় সিরাজ উদ্দিন ইব্রাহিম ও সুলতানকে রেল স্টেশনের প্লাটফরমের পশ্চিম দিক দিয়ে রেল লাইন ক্রস করে বাজারের ভেতর দিয়ে ক্যাম্পের কাছাকাছি এবং মান্নান ও সমর কষ্টাকে রেল স্টেশনের পূর্বপাশে প্লাটফরমের ঢালুতে কভারিং ফায়ারের জন্য পজিশন নেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি নিজে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে স্টেশনের পূর্বদিক দিয়ে একজন সাধারণ মানুষের বেশে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যান। ক্যাম্পের সেন্ট্রিদের চক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে অতি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তিনি হানাদারদের ক্যাম্পের জানালা দিয়ে গ্রেনেড চার্জ করেন। পূর্ব নির্দেশমতো গেরিলাদের অন্য দুটি গ্রুপও গোলাবর্ষণ শুরু করে। আক্রমণের আকস্মিকতায় প্রথমে হতচকিয়ে গেলেও হানাদারদের সেন্ট্রিরাও আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এলএমজি ও রাইফেল থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
এলএমজি-র ব্রাশ ফায়ারে পশ্চিম দিকে যুদ্ধরত শিবপুরের ইব্রাহিম বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শহীদ হন। প্রায় দুঘণ্টা প্রচণ্ড গুলি বিনিময়ের পর ক্যাম্পের ১৫ জন পাকসেনার সকলে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পালানোর সময় দুজন পাকসেন নিহত হয়। ১টা এলএমজি, ১টা স্টেনগান ও ১১টি রাইফেল ছাড়াও বেশ কিছু গোলাবারুদ, চাল-ডাল ও প্রচুর নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। সেগুলোর মধ্যে ছিল ৪৫০০ রাউন্ড মেশিন গানের গুলি, ১০০ রাউন্ড স্টেনগানের গুলি, ১৪টি বেল্ট, ২৬ জোড়া জুতা, ১৭ ব্যাগ আটা, ১১ পেটি দুধের টিন ও বেশ কিছু মশারি। এ-যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা রেল স্টেশনটি বিধ্বস্ত করেন এবং স্টেশনের টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ সাফল্যে মুক্তিযোদ্ধারা এক নতুন উদ্দীপনা ও প্রচুর মনোবল লাভ করে। এতদিন কিছুটা সংশয় থাকলেও এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পর জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য সম্পর্কে পুরোপুরি আস্থা স্থাপন করে। অন্যদিকে এ যুদ্ধের পর ন্যাভাল সিরাজ পাকবাহিনীর কাছে এক আতঙ্ক হিসেবে দেখা দেন। [মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড