বীর প্রতীক জামিল ডি আহসান
জামিল ডি আহসান, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫১) সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, পরবর্তীতে মেজর জেনারেল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫১ সালের ১১ই মে চট্টগ্রাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক সূত্রে তাঁর বাড়ি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার নেপালতলী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ জসিম উদ্দীন এবং মাতার নাম বেগম হোসনে আরা জেসমিন। ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে জামিল ডি আহসান ৫ম। তিনি ১৯৬৭ সালে যশোর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৯ সালে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যায় বিএসসি (অনার্স)-এ ভর্তি হন। কলেজ জীবন থেকে তিনি প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভের পরও ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে জামিল ডি আহসান পূর্ব বাংলার ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করেন। ৭১-এর ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনেন এবং তখন থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যার দিন তিনি ঢাকায় ছিলেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে তিনি ভারতের আগরতলা যান। সেখানে এপ্রিল মাসের শেষদিকে পিআইএ-এর পাইলট ফ্লাইং ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হলে তিনি তাঁকে মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর নিকট নিয়ে যান এবং তাঁর সহযোগিতায় মেলাঘর ট্রেনিং সেন্টারে ৫ নম্বর প্লাটুনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট হন। মেলাঘরে ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে সেখান থেকে জামিল ডি আহসানসহ ১৭ জনকে প্রথম বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সের জন্য বাছাই করা হয়। অতঃপর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে মূর্তি ট্রেনিং সেন্টার থেকে সাড়ে তিন মাসের প্রথম বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্স সমাপ্ত করেন। ৯ই অক্টোবর মুজিবনগর সরকার-এর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল এম এজি ওসমানী , ৬ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এ বি এম খাদেমুল বাশার, মূর্তি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জোশি প্রমুখ তাদের পার্সিং আউট অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এদিনই জামিল ডি আহসান সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং ৩ নম্বর সেক্টরে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ নাসিমের অধীনে তাঁকে সিলেটের খোয়াই চা বাগান এলাকায় পোস্টিং দেয়া হয়। এ চা বাগান এলাকা থেকেই তিনি চুনারুঘাট এলাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। তাঁকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফারের অধীনে বদলি করা হয় এবং তাঁকে চার্লি কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স ছিল বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ভারতের প্রায় দুই কিমি ভেতরে। এর সম্মুখে কুমিল্লার সালদা নদী, নয়নপুর ও মন্দবাগ এলাকা। সালদা নদীর পাড় ও আশপাশের এলাকায় পাকবাহিনীর ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা বিভিন্ন পয়েন্টে মেশিনগান সেট করে এবং নদীর ওপারে পরিত্যক্ত বাড়িতে সিমেন্ট দিয়ে বাঙ্কার তৈরি করে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্দেশ আসে সালদা নদী এলাকা থেকে পাকবাহিনীকে বিতাড়িত করার। এজন্য নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে সালদা নদীর পাড়ে স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এ আক্রমণে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জামিল ডি আহসানের নেতৃত্বে চার্লি কোম্পানি, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মমতাজ হোসেনের আলফা কোম্পানি, লেফটেন্যান্ট ফজলুল হকের ডেল্টা কোম্পানিসহ ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। এঁদের সঙ্গে যোগ দেয় আর্টিলারি মুজিব ব্যাটারি। সালদা নদীর তীরে স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে জামিল ডি আহসান তাঁর কোম্পানিকে ৪টি প্লাটুনে ভাগ করে তাঁর সঙ্গে এক প্লাটুন, সুবেদার ওহাবের সঙ্গে এক প্লাটুন, সুবেদার বেলায়েতের সঙ্গে এক প্লাটুন ও সুবেদার শহীদের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্যসহ ভোররাতে পাকবাহিনীর আবস্থানের কাছাকাছি চলে যান। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে আর্টিলারি ফায়ারের সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেট করে গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকে থাকতে না পেরে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং সালদা নদীর পাড়ে স্থাপিত হানাদারদের ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
৫ই ডিসেম্বর জামিল ডি আহসানের চার্লি কোম্পানিসহ ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা বেলোনিয়াতে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে একত্রিত হন। তারপর শুভপুর নদী পার হয়ে করের হাট, রামগড় ও হাটহাজারী হয়ে ১৬ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার জামিল ডি আহসানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে লিবিয়ায় রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করে। ২০০৬ সালে তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তবে রাষ্ট্রদূতের চাকরিতে বহাল থাকেন এবং ২০০৭ সালে তিনি পুরোপুরি অবসরে যান। বীর মুক্তিযোদ্ধা জামিল ডি আহসান, বীর প্রতীক সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর স্ত্রীর নাম বীথি জামিল। এ দম্পতি ২ পুত্র সন্তানের জনক-জননী। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড