মুক্তিযুদ্ধে জামালপুর সদর উপজেলা
জামালপুর সদর উপজেলা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুর জেলা ছিল ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমা। মহান মুক্তিযুদ্ধে জামালপুর সদর উপজেলার রয়েছে গৌরবময় অবদান। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এতে সারা দেশের মতো জামালপুরের মানুষও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- তখন অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দিলে জামালপুর সদরের সর্বস্তরের মানুষ সে আন্দোলনে শরিক হয়।
দলগতভাবে জামালপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা- কর্মীরাও এতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পরই মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ২রা মার্চ স্থানীয় পুনাই পার্কে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে ছাত্রলীগের ফজলুল বারী তারা, ছাত্র ইউনিয়নের সুকুমার চৌধুরী, ফয়েজুর রহমান প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সভাপতিত্ব করেন আশেক মাহমুদ কলেজের ভিপি সোলায়মান হক (ছাত্রলীগ)। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর জামালপুর সদর উপজেলায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৩ই মার্চ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জামালপুর শহরের গৌরীপুর মাঠে এক জনসভার আয়োজন করে। সেখানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পোড়ানো এবং মানচিত্র-সম্বলিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন আব্দুল মতিন হীরু এবং সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আব্দুল মান্নান। পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর ক্ষেত্রে খন্দকার হাফিজুর রহমান বাদশাসহ অনেকে যুক্ত ছিলেন। সভায় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুশান্ত দেব কানু, ডা. জাহানারা ও অন্যান্য শিল্পীরা।
২৩শে মার্চ জামালপুর সদরে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। ২৪শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন এডভোকেট মো. আব্দুল হাকিম এমএনএ, আক্তারুজ্জামান এমপিএ, এডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার, অধ্যাপক সৈয়দ ইমামুর রশীদসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। পরবর্তীতে জামালপুর সদর উপজেলায় ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। শহরের দয়াময়ী মাঠ, তমালতলার নিচে নদীর পাড়ে ও আশেক মাহমুদ কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হয়। ডামি অস্ত্র দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ দেন অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর সুবেদার আব্দুল হাকিম।
জামালপুর সদরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন- আওয়ামী লীগের এডভোকেট মো. আবদুল হাকিম এমএনএ, মো. আশরাফ হোসেন এমপিএ, এডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার, রেজাউল করিম হীরা, দিদারুল আলম খুররম, ওয়াহেদ মাস্টার, সৈয়দ আলী মণ্ডল প্রমুখ এবং ন্যাপের মন্মথনাথ দে, ক্ষিতীশ তালুকদার, এডভোকেট আবদুস সোবাহান, অধ্যাপক ইমামুর রশীদ, মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ প্রমুখ। ছাত্রলীগের যে-সকল নেতা সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন তাঁরা হলেন- ফজলুল বারী তারা, মোহাম্মদ চ শহিদুল্লাহ, সোলায়মান হক, আব্দুল মতিন হীরু, আমজাদ হোসেন মল্লিক, হাফিজুর রহমান বাদশা, এম রিয়াজুল হক, শফিকুল ইসলাম খোকা প্রমুখ। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন- ফয়েজুর রহমান, সুকুমার চৌধুরী, উৎপল কান্তি ধর, সিদ্দিকুর রহমান, মাহবুবুর রহমান আনসারী, খায়রুল আলম, সাইদুর রহমান হিমু, ধনঞ্জয় মণ্ডল প্রমুখ।
২৫শে মার্চ পাকবাহিনী কর্তৃক ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে তার প্রতিবাদে ২৬শে মার্চ বিকেলে স্থানীয় গৌরীপুর মাঠে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন তাছির উদ্দিন মোক্তার। এরপর থেকে পাকবাহিনী জামালপুরে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন লাঠিসোঠা নিয়ে বিক্ষোভ করে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করত। পাকবাহিনী যাতে জামালপুরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্থানীয় ছাত্র- জনতা, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতা-কর্মী এবং ইপিআর সদস্যরা জামালপুরের প্রবেশপথে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনীর অস্ত্রবাহী একটি ট্রেন জামালপুর স্টেশন অতিক্রমকালে ছাত্র- জনতা ট্রেনটি আটক করে এবং তিনদিন পর্যন্ত ট্রেনটি আটকে রাখে। ইপিআর সুবেদার আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে এবং বিমান বাহিনীর সদস্য মাহবুব হোসেন চৌধুরী ও নৌবাহিনীর সদস্য মিন্টুর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা মধুপুর ব্রিজ এবং জামালপুর সীমানার কয়েকটি কালভার্ট ধ্বংস করে পাকবাহিনীর প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। ২০শে এপ্রিল সকালে পাকিস্তানের জঙ্গি বিমান জামালপুরে আঘাত হানে। রেলস্টেশন, মালগুদাম রোড ও ব্রহ্মপুত্রের ফেরিঘাটসহ অনেক জায়গায় বোমা ফেলা হয়। বিমান থেকে গুলিও চালানো হয়। ঐদিন ফেরিঘাটে ৭ জন লোক নিহত হয়। পরে হানাদার বাহিনীর হামলার মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে-করতে মধুপুর হয়ে জামালপুর শহরে প্রবেশ করে এবং জামালপুর- মধুপুর সড়কের পাশে পিটিআই ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। জামালপুর সদর উপজেলায় জুন-জুলাই মাসে আলবদর- ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামী-র ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় আলবদর বাহিনী। জামালপুরেই প্রথম বদরবাহিনী গঠিত হয়। ইসলামী ছাত্র সংঘের জামালপুর মহকুমার নেতা আশরাফ হোসাইন ছিল আলবদর বাহিনী গঠনের উদ্যোক্তা, এর সংগঠক ও কমান্ডার।
জামালপুর সদর উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী দল ও সংগঠন ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, পিডিপি ও ইসলামী ছাত্র সংঘ। এদের নিয়ে গঠিত হয় শান্তি কমিটি। উপজেলায় শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল মো. ইউসুফ আলী (সিংহজানী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপনির্বাচনে নির্বাচিত এমপিএ), মক্তব আলী কবিরাজ (‘কল্পতরু’ আয়ুর্বেদীয় ঔষধের দোকানের মালিক) সেক্রেটারি ছিল— মো. আজিজুর রহমান (আশেক মাহমুদ কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল), মো. সামছুল হক (জামালপুর ফৌজদারি কোর্টের উকিল), মো. আবদুল গণি (আশেক মাহমুদ কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক), মো. গোলাম রব্বানী (আশেক মাহমুদ কলেজের রসায়নের শিক্ষক), মো. কামরুল ইসলাম (বকুলতলাস্থ সেকান্দার হোমিও হলের মালিক এবং আশেক মাহমুদ কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক আবদুল গণির ভাই), ডা. মো. আব্দুস ছামাদ (বকুলতলার হোমিও ডাক্তার), মো. মোতাহার হোসেন খান (শান্তি কমিটির কোষাধ্যক্ষ) ও মো. মোজাম্মেল হক (আশেক মাহমুদ কলেজের দর্শনের শিক্ষক)। শান্তি কমিটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী পাকবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ধরে এনে হত্যা করত এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন দিত। শান্তি কমিটির উদ্যোগে পাড়া-মহল্লায় স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নিয়ে রাত্রিকালীন পাহারার দল গঠন করা হয়েছিল।
জামালপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সাধনা ঔষধালয় দখল করে রাজাকারআলবদররা তাদের অফিস খোলে। ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনীর কিলিং স্কোয়াড গঠিত হয়। আলবদর বাহিনী ও এর কিলিং স্কোয়াডের সক্রিয় সদস্য ছিল- মো. আব্দুল বারী (বগাবাইদ), মো. মোতাহার হোসেন (ফুলকোচা), মো. আব্দুল মান্নান (কাচারীপাড়া), মো. হারুন (কাচারীপাড়া), মো. আব্দুল খালেক (ভাটারা), মো. মাহবুব (দেওয়ানপাড়া), মো. আজাদ (কলেজ রোড; আশেক মাহমুদ কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ও শান্তি কমিটির সদস্য মো. আজিজুর রহমানের ছেলে), মো. আরজু (দেওয়ানপাড়া), মো. লুৎফর (মেডিকেল রোড; শান্তি কমিটির সভাপতি মক্তব আলী কবিরাজের ছেলে), মো. আব্দুল বাকী (বকুলতলা; হোমিও ডাক্তার ও শান্তি কমিটির সদস্য আব্দুস ছামাদের ছেলে), মো. হাশেম আলী (কাচারীপাড়া) এবং মো. রুমি (নয়াপাড়া খয়ের ডাক্তারের ছেলে)।
আলবদর ও রাজাকাররা আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতা- কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের খবরাখবর পাকসেনাদের অবহিত করত। এদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মুক্তিকামী সাধারণ মানুষদের ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন চালাত ও হত্যা করত এবং তাদের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করত। আলবদর ও রাজাকার বাহিনী জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ মানুষদের আশেক মাহমুদ কলেজ হোস্টেল ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন করত। তারপর তাদের হত্যা করে বনপাড়াস্থ ফওতি গোরস্তানে মাটিচাপা দিত। তারা হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দিত এবং গ্রামগঞ্জ থেকে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি লুট করে এনে পাকক্যাম্পে সরবরাহ করত। এমনকি তারা পাকহানাদার বাহিনীর মনোরঞ্জনের জন্য নারীদেরও সরবরাহ করত।
২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী জামালপুরে প্রবেশে করে সিক্স ইন পাউন্ডারের গোলায় বেলটিয়া, গুয়াবাড়ি, কাচামজা ও পাথালিয়া গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। সেদিন তারা জামালপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র তমালতলায় শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকাইপট্টির বেশকিছু দোকানপাট লুট করে অগ্নিসংযোগ করে। বকুলতলায় টিএন্ডটি অফিসের ছয়জন কর্মচারীকে পিটিআই ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। গুদারাঘাট ও পাথালিয়ায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন সমর্থককে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী বহু মানুষকে ধরে এনে শেরপুর ফেরিঘাটের পাশে কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাটে নিয়ে চোখ বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী প্রায় সোয়া তিনশ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী দয়াময়ী মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুণ্ঠন চালায়, শক্তিশালী বিস্ফোরণের দ্বারা কষ্টিপাথরে নির্মিত দয়াময়ী মহাদেব্যা মাতার বিগ্রহ উড়িয়ে দেয়। তারা রৌপ্যনির্মিত সিংহাসনসহ বিগ্রহের লক্ষ-লক্ষ টাকার স্বর্ণালংকার, তৈজসপত্র এবং বিভিন্ন সম্পদ লুট করে। শান্তি কমিটির চাপে জামালপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের (বর্তমান জিলা স্কুল) সহকারী শিক্ষক অরুণ চন্দ্র রায় ধর্মান্তরিত হয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য হন। বদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকবাহিনী আমলাপাড়ার হিন্দু আবাসিক এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। তারা ফটোগ্রাফার কানুদের বাড়ি ও জামালপুর হাইস্কুলের শিক্ষক সলিল কাহালির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের শিক্ষক প্রদীপ কান্তি মজুমদারের বাড়িতে লুটপাট চালায়। পাকবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজের পিতা আব্দুল হামিদ মোক্তারকে তাঁর গ্রামের বাড়ি সরিষাবাড়ির ভাটারা থেকে পিটিআই ক্যাম্পে ধরে আনে এবং শ্মশানঘাটে নিয়ে অন্য অনেকের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। তারা জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ ইমামুর রশীদকে (ন্যাপ-মোজাফফর-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক) মে মাসের প্রথম দিকে তাঁর মিয়াপাড়াস্থ বাসা থেকে পিটিআই ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন করে। পাকবাহিনী বজ্রাপুরের আব্দুল ওয়াহাবকে (ন্যাপ-ভাসানী-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) এবং দেওয়াপাড়ার সায়দুর রহমান সাধুকে পিটিআই ক্যাম্পে ধরে এনে কয়েকদিন নির্যাতনের পর হত্যার উদ্দেশ্যে শ্মশানঘাটে নিয়ে অন্য অনেকের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রথমজন পানিতে পড়ে গিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান এবং দ্বিতীয় জন গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে জীবন রক্ষা করেন। আশেক মাহমুদ কলেজের কেরানি দেওয়ান পাড়ার আব্দুস ছাত্তারকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে তার ওপর নির্যাতন করে। তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের স্থানীয় সাংবাদিক আহসান আলী এবং দেওয়ান পাড়ার শমসের মহুরীর ছেলে মিন্টুকে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে।
জামালপুর সদরে পিটিআই ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। পিটিআই নির্যাতনকেন্দ্র এ পাকবাহিনী আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতা-কর্মী, সমর্থক এবং মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে ধরে এনে এই ক্যাম্পে বন্দি করে রাখত এবং তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাত। পাকবাহিনীর দোসর রাজাকারআলবদর বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি ছিল আশেক মাহমুদ কলেজের হোস্টেল। আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজ নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি-তে বহু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এছাড়া পাকবাহিনীর নারীনির্যাতন কেন্দ্র ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে বলপূর্বক মেয়েদের এখানে ধরে এনে নির্যাতন ও ধর্ষণ করত।
জামালপুর সদর উপজেলায় ৩টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো- রশিদপুর ঘাট বধ্যভূমি, পিয়ারপুর নদীর ঘাট বধ্যভূমি- ও ছনকান্দা শ্মশানঘাট বধ্যভূমি। রশিদপুর ঘাট বধ্যভূমিতে পাকসেনারা বহু সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। পিয়ারপুর নদীর ঘাট বধ্যভূমিতে পাকসেনারা বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে। ছনকান্দা শ্মশানঘাট বধ্যভূমিতে দিনের পর দিন অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে চোখ বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
এ উপজেলায় একটি গণকবর রয়েছে – বনপাড়া ফৌতি গোরস্থান গণকবর। পাকবাহিনীর ক্যাম্পে বা আলবদর-রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্পে যাদের হত্যা করা হতো, তাদের এ গোরস্থানে কবর দেয়া হতো।
২৫শে জুন নরুন্দি রেলস্টেশন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে অনেক রাজাকার আহত হয় এবং এক পর্যায়ে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনীর নান্দিনা ক্যাম্প অপারেশন- পরিচালিত হয়। এতে ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও একজন আলবদর নিহত হয়।
জামালপুর সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হয় জামালপুর সদর যুদ্ধ। ৪ঠা ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটির পতন হলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে জামালপুর সদরের দিকে অগ্রসর হয়। ৯ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে ২৩৫ জন পাকসেনা নিহত, ২৩ জন আহত এবং যৌথবাহিনীর হাতে ৬১ জন বন্দি হয়। অপরদিকে মিত্রবাহিনীর একজন মারাঠা সৈন্য, লাইন ইনফ্যান্টির ১০ জন ও ১৩ গার্ড রেজিমেন্টের একজন সৈন্য শহীদ এবং ৮ জন আহত হন। ১০ই ডিসেম্বর জামালপুর সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম (পিতা ওসমান আলী চৌধুরী, চন্দ্রা), মো. বিলাল উদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা জাবেদ আলী, গোপালপুর) ও সৈয়দ সদরুজ্জামান, বীর প্রতীক (পিতা সৈয়দ কামরুজ্জামান, মিয়াপাড়া)।
জামালপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- দুলাল কুমার দাস, (পিতা অজিত কুমার দাস, বসাকপাড়া), গজনবী (পিতা নাহার মণ্ডল, পাথালিয়া), ইদ্রিস আলী, (পিতা কেনা মিয়া, পাথালিয়া), তোফাজ্জল হোসেন, (পিতা হোসেন আলী সরকার, মোহনপুর), আ. ওয়াহেদ, (পিতা নিতন আলী খাঁ, খড়খড়িয়া), আজিজুর রহমান (পিতা জহির উদ্দিন, নান্দিনা), আইজ উদ্দিন (পিতা মান্দি শেক, দমদমা), হেলাল উদ্দিন (পিতা আবুবক্কর মণ্ডল, বাড়িখাগুড়ি), নাজিম উদ্দিন (পিতা হাজী মোহাম্মদ আলী, মৌহাডাংগা), শাহজাহান আলী (পিতা আ. জব্বার সরকার, খড়খড়িয়া), হাবিবুর রহমান (পিতা গমেজ শেখ, পাথালিয়া), হারুনুর রশীদ (পিতা সেকান্দর আলী, যোগীরগোপা), জামাল উদ্দিন (পিতা নাছির উদ্দিন, আড়ালিয়া) এবং রাজ মাহমুদ (পিতা জহির উদ্দিন, নান্দিনা)।
জামালপুর শহরের বোসপাড়ায় দয়াময়ী মন্দিরের পাশে বৈশাখী মাঠের প্রান্তে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে, যা বৈশাখী মাঠ স্মৃতিস্তম্ভ নামে পরিচিত। জেলা প্রশাসনের উদ্যগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। শহরের বনপাড়াস্থ ফৌতি গোরস্থানে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা বনপাড়া ফৌতি গোরস্থান স্মৃতিস্তম্ভ- হিসেবে পরিচত। এছাড়া ছনকান্দা শ্মশানঘাট বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে আরো একটি স্মৃতিসৌধ। সদর উপজেলার দেওয়ানপাড়ার শেষ মাথায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কাছে তিন রাস্তার মোড়ের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মাস্টার চত্বর। জামালপুর সদরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামে বেশ কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— শহীদ আব্দুল হামিদ সড়ক, শহীদ হারুন সড়ক, শহীদ হীরু সড়ক, শহীদ সিদ্দিক সড়ক, শহীদ নূরুল আমিন মল্লিক সড়ক, শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন সড়ক ও শহীদ চাঁদমোহন সড়ক। [আহমদ আজিজ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড