You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম জাফর ইমাম - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম জাফর ইমাম

জাফর ইমাম, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৮ সালের ১৩ই ডিসেম্বর বর্তমান ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ ওয়াহিদ উল্লাহ চৌধুরী এবং মাতার নাম আজমেরী বেগম। তিনি ১৯৬৩ সালে ফেনী পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৫ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বিএ (অনার্স) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে তিনি কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং ৯ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের খারিয়া সেনানিবাসে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে জাফর ইমাম ক্যাপ্টেন পদে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে -অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু করলে তার প্রতিবাদে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ২৬শে মার্চ তাঁর ইউনিট (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট)সহ তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পালিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এক সপ্তাহ পরে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয় এবং সেখানে যাবার জন্য তাঁকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে নিয়ে আসা হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বিমান বন্দর থেকে পালিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের বাঙালি আফিসার ক্যাপ্টেন আব্দুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন, বীর প্রতীক- ও ক্যাপ্টেন আবু জাফর মোহাম্মদ আমিনুল হক, বীর উত্তম-এর সঙ্গে একত্রে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগরতলার মেলাঘরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরবর্তীতে সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জাফর ইমাম ২নং সেক্টরের অধীন রাজনগর সাব- সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ৭ই অক্টোবর ২নং সেক্টরে যুদ্ধরত নিয়মিত বহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন (৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুনর্গঠিত ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) নিয়ে খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ব্রিগেড আকারে ‘কে’ ফোর্স গঠন করা হলে মেজর পদে পদোন্নতি দিয়ে জাফর ইমামকে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে বহু সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিলোনিয়ার যুদ্ধ, বিশেষ করে বিলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ। জাফর ইমামের নেতৃত্বে ৬ থেকে ১০ই নভেম্বর বিলোনিয়ায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুরো ব্যাটালিয়ন (আলফা, ব্রাভো, চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি) এবং ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম-এর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানি। যুদ্ধে বহু পাকসেনা হতাহত হয় এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ একজন পাকক্যাপ্টেন ও ৭২ জন সেনা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন একটি পুরো ব্যাটালিয়ানসহ সুরক্ষিত শত্রু-এলাকায় প্রবেশ করে সেখানে বাংকার খুঁড়ে শত্রুসেনাদের একেবারে নিকটে অবস্থান নিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করে দেয়। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এজন্য বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশের মিলিটারি একাডেমিতে সৈনিকদের ট্রেনিং কোর্সের পাঠ্যসূচিতে ‘বিলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ’ (Second Battle of Belonia Budge) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার জাফর ইমামকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৮৭, খেতাবের সনদ নং ১২)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে জাফর ইমাম তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৫ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৬ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৭৯ সালে ফেনী-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি বস্ত্র ও পাট, পরিবেশ ও বনসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ফেনী জেলার রাজাপুরে ‘জাফর ইমাম বীর বিক্রম হাইস্কুল’, ছাগলনাইয়ায় ‘জাফর ইমাম বীর বিক্রম হাইস্কুল’ এবং ফুলগাজীতে ‘জাফর ইমাম হাইস্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি নিঃসন্তান। তাঁর স্ত্রীর নাম নূর মহল বেগম। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড