মুক্তিযুদ্ধে জলঢাকা উপজেলা (নীলফামারী)
জলঢাকা উপজেলা (নীলফামারী) নীলফামারী সদর উপজেলা থেকে উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত। ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম দিক থেকেই জলঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। দেশের অপরাপর অঞ্চলের মতো জলঢাকার সচেতন মানুষও পাকিস্তান সামরিক শাসকগোষ্ঠীর ১৯৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ-এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র বুঝতে পারে। এর প্রতিবাদে এখানকার সংগ্রামী জনতা ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে জলঢাকায় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন মো. আমীন বিএসসি এমপিএ এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন মো. জমসেদ আলী মিয়া। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- মিজানুর রহমান চৌধুরী (সদস্য সচিব), ডা. শফিয়ত হোসেন, মোশারফ হোসেন মিয়া, মকবুলার রহমান চৌধুরী, শফিকুল আলম, দুলাল চৌধুরী, আব্দুল হক মাস্টার, আব্দুল আজীজ, শমসের আলী, শহরউল্লা, এম মনসুর আলী, মমতাজ উদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, ইব্রাহীম হোসেন, লুৎফর রহমান, ইয়াকুব মাস্টার, আমিনুর রহমান মাস্টার ও আব্দুল আউয়াল চৌধুরী। এছাড়া সংগঠক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন আফসার আলী আহমেদ, মো. মনসুর আলী, আব্দুল গফুর, আব্দুল মালেক, ফজলুল হক, ইব্রাহীম আলী, আনছারুল আলম ছানু, মো. আজাহারুল ইসলাম প্রমুখ।
মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল চৌধুরী, ফজলুল হক এবং মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে জলঢাকা হাইস্কুল মাঠে রাতের বেলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের মুখোমুখি হওয়ার জন্য এ প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত ছিল না। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে মো. মনসুর আলী (পিতা করম আলী) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এক পর্যায়ে তিনি জলঢাকা উপজেলার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর কিছু নেতৃবৃন্দসহ ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার কীভাবে, কতটা সহযোগিতা করতে পারে সে বিষয়ে জলপাইগুড়ির একজন কংগ্রেস নেতার সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করেন এবং তাঁর মাধ্যমে ভারত সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। এরপর তাঁরা শিলিগুড়ি ও কুচবিহারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুরূপ সহযোগিতা কামনা করেন। ঐ সময় আব্দুর রউফ এমএনএ এবং আফসার আলী আহমেদ এমএনএ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জলপাইগুড়ি শহরে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তাঁরা পাকবাহিনীর নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন। মো. মনসুর আলীসহ জলঢাকার নেতৃবৃন্দ এরপর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অণুপ্রাণিত করেন। ২৭শে এপ্রিল কালীগঞ্জ হত্যাযজ্ঞের পর মো. মনসুর আলী পুনরায় সীমান্ত অতিক্রম করে দীনহাটা শহরে প্রবেশ করে দীনহাটা ফরোয়ার্ড ব্লকের সংসদ সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী কমল গুহের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সহযোগতিা চান। ঐ সময় কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থানায় স্থানীয়দের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হলে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) মনসুর আলীসহ কিছু ছাত্রলীগ কর্মীকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ভুরুঙ্গামারীতে পাঠান। কিছুদিন পর প্রশিক্ষণের জন্য তারা বিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে মুর্তি ক্যাম্পে যান। এখানে প্রশিক্ষণ শেষে কয়েকজন সঙ্গীসহ মনসুর আলী হলদীবাড়িতে এসে মুজিব বাহিনী-তে যোগ দেন।
এ উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন— মিজানুর রহমান চৌধুরী (মুজিব বাহিনীর কমান্ডার), আনছারুল আলম ছানু (মুজিব বাহিনীর কমান্ডার, শিমুলবাড়ি) এবং হামিদুর রহমান (প্লাটুন কমান্ডার)। কমান্ডার আনছারুল আলম ছানু সীমান্তের ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে খোঁজখবর নিতেন। তাঁর দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক এবং মো. আনোয়ার হোসেন শিমুলবাড়ি ইউনিয়নের খবরাখবর তাঁর কাছে পৌছে দিতেন। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের সোনাদানা, গরু-ছাগল ইত্যাদি তাঁদের বাড়িতে আমানত রাখত।
এ উপজেলার যে-সকল মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধ করেন, তাঁরা হলেন- মো. মনসুর আলী (পিতা করম আলী; মুজিব বাহিনীর সদস্য, ৬নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন), ওমর ফারুক (পিতা মমতাজ উদ্দীন, শিমুলবাড়ি; অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, ৬নং সেক্টরে উইং কমান্ডার এম কে বাশার ও প্লাটুন কমান্ডার সদর উদ্দীনের অধীনে যুদ্ধ করেন), প্রমথ চন্দ্র রায় (পিতা সারদা মোহন, রাজবাড়ি, শিমুলবাড়ি; ৫নং সেক্টরে মেজর মীর শওকত আলী ও প্লাটুন কমান্ডার নুর হোসেনের অধীনে যুদ্ধ করেন) ও আব্দুল গফ্ফার (পিতা জামালউদ্দীন আহমেদ, পশ্চিম বালাগ্রাম; ৬নং সেক্টরের অধীন সাব-সেক্টর বড়শসী বকদুল ঝোলা, বোদা, পঞ্চগড় এলাকায় যুদ্ধ করেন)। জলঢাকার সংগ্রামী জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য থানার ওসি লুৎফর রহমানের কাছে থানা থেকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানায়। কিন্তু ওসি অস্ত্র দিতে অস্বীকার করলে জনতা অস্ত্র ছাড়াই প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
প্রাথমিক প্রতিরোধ হিসেবে জলঢাকাবাসী বড়ঘাটের পুলের দুপাশ কেটে ফেলে, যাতে পাকবাহিনী গাড়ি নিয়ে এ অঞ্চলে ঢুকতে না পারে। এছাড়া রাস্তায় গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
২৩শে এপ্রিল ডোমারের আব্দুর রউফের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে পাকবাহিনী জলঢাকা উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। এরপর তারা জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং এলএসডি গোডাউনে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে তারা কয়েকটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পগুলো হলো– বালাগ্রাম, কৈমারী, মীরগঞ্জ, টেংগনমারী হাইস্কুল এন্ড কলেজ এবং গোলমুণ্ডা নেকবক্ত। ক্যাম্পগুলোতে হিন্দু সম্প্রদায় ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন ধরে এনে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। এসব ক্যাম্পের রাজাকাররা আশপাশের বাড়িঘর থেকে সোনা-দানা, গরু-ছাগল ইত্যাদি লুট করে নিয়ে আসত।
জলঢাকা উপজেলায় জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে শান্তি কমিটি রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল হাজী আফতাব উদ্দিন (কাজীর হাট)। সে ছিল এ অঞ্চলের সব ধরনের অপকর্মের মূল হোতা। শান্তি কমিটির শীর্ষস্থানীয় সদস্য ছিল- মনোয়ার হোসেন চৌধুরী (বগুলাগাড়ি), মাহতাব উদ্দীন চেয়ারম্যান (বালাগ্রাম), জবান উদ্দীন (কাঁঠালী), আব্বাস চেয়ারম্যান, ডা. মোফাজ্জল হোসেন, মমতাজ হোসেন চৌধুরী, কাজী আব্দুল লতিফ চেয়ারম্যান ( মুসলিম লীগ নেতা ও পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী কাজী আব্দুল কাদেরের ভাই), আজিজার রহমান, আফসার আলী ঘোষ (কাজীর হাট), গণি মিয়া ও আবেদ কাজী। এরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ওপর নানা নির্যাতনসহ হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে। এখানে তিন শতাধিক রাজাকার ছিল। কাজী আব্দুল কাদের ও তার ভাই আব্দুল লতিফের প্রত্যক্ষ পরামর্শ ও নির্দেশনায় এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতা মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, জবান উদ্দিন, আবুল হোসেন মাস্টার ও সোলাইমান আলীর সহযোগিতায় রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। শীর্ষস্থানীয় আলবদর ছিল আব্দুল গনি, আব্দুস সোবাহান ও ডা. লুৎফর রহমান। জলঢাকা হাইস্কুল ক্যাম্পে পাকবাহিনী পাকাপোক্তভাবে ঘাঁটি স্থাপন করার পর থেকে বিভিন্ন ইউনিয়নে অবস্থানরত রাজাকার ক্যাম্পগুলোর সঙ্গে তারা যোগাযোগ রক্ষা করত এবং রাজাকারদের পরামর্শ মোতাবেক অপারেশন করত। এক একটি রাজাকার ক্যাম্পে গড়ে ৭০-৮০ জন রাজাকার অবস্থান করত। এসব ক্যাম্পে শীর্ষস্থানীয় রাজাকার ছিল কফিল উদ্দীন, মাহবুবুর রহমান (শৌলমারী), মোজাম্মেল হক, তোফাজ্জল হোসেন, আব্দুর রহমান, বদরুল ইসলাম, মহিউদ্দীন, রেজাউল করিম, ওমর আলী প্রমুখ।
জলঢাকায় পাকবাহিনী স্থায়ীভাবে ক্যাম্প চালু করার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করত। জুন মাসের মাঝামাঝি সময় হাজী আফতাব উদ্দীনের পরামর্শে মতি মাস্টারকে (পোস্টমাস্টার) পাকসেনারা জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন করে। নির্যাতন শেষে তাঁকে হত্যা করে স্কুলের পেছনে মাটিচাপা দেয়। জলঢাকা উচ্চ বিদ্যালয়ের তেঁতুল গাছটি ছিল কালের সাক্ষী। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা মুক্তিকামী লোকদের এখানে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করত। প্রথমে পা রশি দিয়ে বেঁধে তেঁতুল গাছে ঝুলিয়ে রাখত; কথা বের করার জন্য গরম পানিতে মাথা ডুবিয়ে রাখত। এরপর পাকবাহিনীর নির্দেশে রাজাকাররা বেয়নেট দিয়ে তাদের ক্ষত-বিক্ষত করে ক্ষতস্থানে লবণ আর মরিচের গুঁড়া লাগাত। চোখ বেঁধে অন্ধকারে বহু মানুষকে একসঙ্গে ঠাসাঠাসি করে রাখত। দিনের পর দিন তাদের অনাহারে রাখত। রাজাকারদের সহযোগিতায় বাড়ি থেকে পুরুষদের ধরে আনার পর পাকসেনারা নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। এসব নারীর পরিবারকে হুমকি দেয়া হতো যেন তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে না যায়, তাদের এসব নির্যাতনের কথা যেন বাইরে না বলা হয়। নারীরা যখন ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত তখন তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে কাউকে-কাউকে সৈয়দপুর ও রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হতো এবং বাকিদের হত্যা করা হতো। পাকসেনারা তাদের বাংকার তৈরি করার জন্য সাধারণ লোকদের দিয়ে মাটি কাটাত। কৈমারী ক্যাম্পে পাকসেনারা রাজাকারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্রসহ নিজ-নিজ এলাকায় পাঠাত। এলাকায় গিয়ে রাজাকাররা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাত। নারীদের ধরে এনে বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিত। কৈমারী ক্যাম্পের রাজাকাররা বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের ধরে এনে প্রথমে নিজেরা ভোগ করত এবং পরে তাদের পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত। এ সকল নারীদের প্রথমে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হতো এবং সেখানে কিছু নারীকে রেখে বাকিদের রংপুর ও দিনাজপুর সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হতো। জলঢাকায় ১৫ জনের অধিক বীরাঙ্গনা-র কথা জানা যায়। নারীদের সম্পর্কে পাকসেনাদের তথ্য সরবরাহ করত বদিউদ্দিন রাজাকার। জনৈক নারীকে সে জোরপূর্বক বিয়ে করে।
রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাড়িতে হামলা করে তাঁর পিতা আব্দুল হক চৌধুরী, ভাই মাকছুদার রহমান চৌধুরী ও হাফিজুর রহমান চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে জলঢাকা পাইলট হাইস্কুলের পেছনে (বর্তমানে মোমিনুর রহমান পাটোয়ারীর বাসার সামনে) মাটিচাপা দেয়। এসব এলাকার রাজাকাররা পূর্ব বালাগ্রাম, পশ্চিম বালাগ্রাম এবং চাওড়াডাঙ্গীর হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে লুণ্ঠন চালায়। মাহতাব চেয়ারম্যান এতে নেতৃত্ব দেয়। মাহতাব চেয়ারম্যান ও তার লোকজনের হাত থেকে রক্ষা পেতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হাড়োয়া শিমূলবাড়িতে ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি। এর নেতৃত্বে ছিল রাজাকার ওমর আলী, রেজাউল ইসলাম, আফসার মাস্টার ও জাকের মাস্টার। তাদের গুপ্তচররা সারাক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নজরদারি করত। খুটামারা ইউনিয়নের রাজাকাররা মুক্তিকামী মানুষদের পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত। এলাকার বাড়িঘরে লুণ্ঠন চালাত। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর অধিক নির্যাতন চালাত। তাদের বাড়িঘরে লুটপাট করত। এদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে পালিয়ে যায়। ২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনী কালীগঞ্জে ভারতগামী তিন শতাধিক শরণার্থীকে গুলি করে হত্যা করে, যা কালীগঞ্জ গণহত্যা নামে পরিচিত।
মুসলিম লীগ নেতা কাজী আব্দুল কাদেরের বাড়ি ছিল শৌলমারী। প্রথম থেকেই এখানকার লোকজন রাজাকারদের দ্বারা অত্যাচারিত হতে থাকে। খুটমারা ইউনিয়নের টেংগনমারী হাইস্কুলের রাজাকার ক্যাম্প সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে পাকসেনাদের গাড়িবহর জলঢাকায় ঢুকত। ফলে রাজাকারদের সঙ্গে তাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও কথাবার্তা চলত। এ এলাকার রাজাকাররা ছিল খুবই ভয়ংকর এখানকার বেশকিছু ডাকাত রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয় এবং তাদের ডাকাতি কৌশল প্রয়োগ করে বাড়িঘরে লুটপাট ও লোকজনের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়।
জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্যাম্পকে পাকবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। বিভিন্ন এলাকা থেকে জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নির্যাতনকেন্দ্র-এ লোকজন ধরে এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হতো। এর নেতৃত্বে ছিল হাজী আফতাব উদ্দীন (উপজেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান) এবং জবান উদ্দীন (শান্তি কমিটির সদস্য)। এছাড়া মীরগঞ্জ বাজারের পশ্চিম পাশে ওয়াপদা ভবনের রাজাকার ক্যাম্প, ধর্মপাল ইউনিয়নের খালের পাড়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্প এবং খুটামারা ইউনিয়নের টেংগনমারী হাইস্কুলের রাজাকার ক্যাম্পেও এলাকার লোকজন ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
আগস্ট মাসের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা গোলমুন্ডা রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিতে আক্রমণ করেন। রাজাকাররাও পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির এক পর্যায়ে ৮ জন রাজাকার নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। এটি গোলমুন্ডা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন নামে পরিচিত। ৯ই ডিসেম্বর জলঢাকা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। ঐদিন জলঢাকা থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন জলঢাকা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাদের হোসেন এবং দোয়া পরিচালনা করেন স্কুলের সেকেন্ড মৌলভী হোসেন আলী। জলঢাকায় একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তিনি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ রায় (পিতা রামমোহন রায়, বালাগ্রাম, জলঢাকা হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র; হাজীগঞ্জ যুদ্ধে শহীদ)।
উপজেলার কালীগঞ্জ গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। ট্রাফিক মোড় থেকে ডালিয়া রোড পর্যন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্রনাথের নামে একটি এবং জিরো পয়েন্ট থেকে উপজেলা পর্যন্ত শহীদ মাকছুদার রহমান চৌধুরীর নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [নাহিদা আলম লুবনা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড