ঈশ্বরদী উপজেলার স্থানীয় মুক্তিবাহিনী জয়বাংলা বাহিনী (ঈশ্বরদী, পাবনা)
জয়বাংলা বাহিনী (ঈশ্বরদী, পাবনা) ঈশ্বরদী উপজেলার একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচু (পরবর্তীতে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা; বর্তমানে প্রয়াত) ও কাজি সদরুল হক সুধা।
ঈশ্বরদী উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকশী ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এর পেছনে ছিল পাকশী ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রাম রূপপুরের রাজনীতি-সচেতন জনগণ ও নেতৃবৃন্দের তৎপরতা। শিক্ষিত ও সমৃদ্ধিশালী এ গ্রামের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ব্রতচারী ও ভাষা-আন্দোলন-এ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেকেই তখন জীবিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে এসব ঋদ্ধ মানুষ উপদেষ্টা ও উৎসাহদাতার ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে রূপপুর গ্রামে তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শের একদল আওয়ামী নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ-এর এসব অভিজ্ঞ নেতৃবৃন্দ ৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, মুক্তিযুদ্ধ অত্যাসন্ন। তাই সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকেই প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করার একটা তাগিদ তাঁরা অনুভব করেন। এ ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে আসেন একদল তরুণ ছাত্রলীগ কর্মী। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অনুপ্রেরণায় প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তারা সংগঠিত হতে থাকেন। সমগ্র পাকশী ইউনিয়ন জুড়েই শুরু হয় তৎপরতা। এ-সময় পাকশীর দুজন বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচু (স্বাধীনতা- পরবর্তী জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা; বর্তমানে প্রয়াত) ও কাজি সদরুল হক সুধার নেতৃত্বে পাকশীতে একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠনের তৎপরতা শুরু হয়। তৎকালীন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে পাকশী রেলওয়ে ফুটবল মাঠে প্রাথমিক অবস্থায় তারা শরীর চর্চা শুরু করেন। পিটি-প্যারেড করানোর দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ রেলওয়ে স্কাউটের লিডার আব্দুল বারী সরদার। তখন পর্যন্ত এ বাহিনীর জন্য কোনো অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করা যায়নি। বাঁশের লাঠিই ছিল তাদের ট্রেনিংএর অস্ত্র।
অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল দলমতনির্বিশেষে আপামর জনগণের উদ্দীপনীয় মন্ত্র। এ স্লোগান শুনলে বিশেষ করে যুবসমাজের রুক্ত টকবগিয়ে উঠত। তৎকালীন গ্রামীণ জনপদেও স্লোগানটি ব্যাপকতা পেয়েছিল। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ তাই এ স্লোগানটিকে তাদের বাহিনীর নামকরণের জন্য বেছে নেন। একই সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন- পাকশীতে যে বাহিনী গঠন করেছিল, তার নাম ছিল ‘রেড স্টার বাহিনী’। এর সদস্যরা লাল তারকা খচিত নেভি ব্লু রঙের টুপি মাথায় পরত।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে রাজধানী ঢাকায় পাকবাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চালায়। অপারেশন সার্চলাইট নামের এ হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশের মতো জেলা শহর পাবনাতেও তারা আক্রমণ চালায়। ২৫শে মার্চ রাত ২টা ৩০ মিনিট অর্থাৎ ২৬শে মার্চ রাজশাহী থেকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পদাতিক সৈন্য পাবনায় এসে পৌঁছায় এবং শহরের ইপসিক এলাকায় আশ্রয় নেয়। এ সংবাদ পাওয়ার পর পাকশীর সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ রাস্তায় বেরিকেড সৃষ্টি করে পাকসেনাদের আগমনে বাধার সৃষ্টি ও হার্ডিঞ্জ সেতুসহ রাস্তাঘাট ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে পাহারার ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নেন। এরই ধারাবাহিকতায় জয়বাংলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতিরাতে পাহারা বসানোর নির্দেশ দেয়া হয়। শুধুমাত্র বাঁশের লাঠি সম্বল করে রাতে পাহারা দেয়া এ বাহিনীর তরুণদের পছন্দ হচ্ছিল না। তারা পাকবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এর জন্য চাই আগ্নেয়াস্ত্র। তারা সিদ্ধান্ত নেন পাকশীতে যাদের লাইসেন্সকৃত বন্দুক ও টু-টু বোর রাইফেল আছে, তাদের কাছ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা বন্দুক ও টু-টু বোর রাইফেলসহ বেশকিছু আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেন। এর আগে ১১ই মার্চ রাতে জয়বাংলা বাহিনীর দুজন প্রতিরোধযোদ্ধা মাহবুল ও নজরুল (পিতা আব্দুল বারী ঠিকাদার) হাতবোমা তৈরি করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়ে মাহবুলের দুহাতের কবজি পর্যন্ত উড়ে যায়। এ ঘটনার পরও জয়বাংলা বাহিনী ক্ষান্ত হয়নি।
২৩শে মার্চ পাকশী রেলওয়ে মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে জয়বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। পতাকা উত্তোলন করেন থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নায়েব আলী বিশ্বাস। পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে জয়বাংলা বাহিনীর সদস্যরা কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকাকে অভিবাদন জানান। এ আবেগঘন মুহূর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক আব্দুর রব দৌড়ে গিয়ে নিজের বাসা থেকে ডবল ব্যারেল বন্দুক এনে তোপধ্বনি করেন।
২৯শে মার্চ জয়বাংলা বাহিনীর জন্য একটি স্মরণীয় দিন। এদিন মাধপুর নামক স্থানে তারা অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত সুশিক্ষিত পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, ২৫শে মার্চের কালরাতে পাকবাহিনীর এক কোম্পানি পদাতিক সৈন্য ইপসিক শিল্প নগরীতে অবস্থান নেয়। ২৮শে মার্চ তারা পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করলে প্রতিরোধ বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর যৌথ আক্রমণে অধিকাংশ সৈন্য পর্যুদস্ত ও নিহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য পাকবাহিনীর একটি দল রাজশাহী থেকে পাবনায় উপস্থিত হয়। তাদের রিকয়েললেস রাইফেলের অনবরত গুলিতে প্রতিরোধ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পাকসেনারা তাদের সৈন্যদের উদ্ধার করে রাজশাহীর দিকে যাওয়ার পথে মাধপুরে জনতার প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। জনতার এ প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে পাকশী রেলওয়ে মাঠে যে সভা হয়, সেখানে বক্তৃতাকালে জয়বাংলা বাহিনীর অসীম সাহসী যোদ্ধা হাবিবুর রহমান রাজু ঘোষণা দেন, ‘মাধপুরের যুদ্ধে যদি কেউ প্রথম শহীদ হয় তবে সে হব আমি।’ মাধপুরের এ অসম যুদ্ধে সত্যিই শহীদ হন রাজু, ওহিদসহ ৫ জন। রাজু ও ওহিদ ছিলেন ছাত্রলীগ কর্মী ও জয়বাংলা বাহিনীর সদস্য।
মাধপুরের যুদ্ধের পর জয়বাংলা বাহিনীর কর্মতৎপরতা আরো বৃদ্ধি পায়। এ কর্মকাণ্ড শুধু পাহারার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অসহযোগ আন্দোলনকালে স্থানীয় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, সংগ্রামরত মানুষদের মনোবল অটুট রাখা, প্রতিরোধ সংগ্রামের খবর আদান-প্রদানের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বও এ বাহিনীর ওপর বর্তায়।
জয়বাংলা বাহিনীর নিষ্ঠা, একাগ্রতা সর্বোপরি দেশাত্মবোধের কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে আসে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনের ইয়ার্ড মাস্টার আকরাম হোসেনের কাছ থেকে জয়বাংলা বাহিনী খবর পায় যে, পাকবাহিনীর ৪টি খাদ্যবাহী ওয়াগন যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। এ খবর পাওয়ামাত্র জয়বাংলা বাহিনীর সদস্যরা ওয়াগনগুলো পাকশী রেল হাসপাতাল সংলগ্ন রেল লাইনে নিয়ে এসে চা, চিনি, চাল, পেট্রোল ইত্যাদি পাকশী বাজারে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করে সমুদয় অর্থ সংগ্রাম কমিটির তহবিলে জমা দেন। এ সপ্তাহেই অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে এ বাহিনী একটা শক্ত অবস্থানে পৌঁছে যায়। কারণ পাবনার বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াজিউদ্দিন জয়বাংলা বাহিনীকে ৩০-৩৫টি থ্রি-নট- থ্রি রাইফেল দেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব ও অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত পাকশী ইউনিয়নে জয়বাংলা বাহিনী প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। ১০ই এপ্রিল পাকসেনারা দ্বিতীয় পর্যায়ে পাবনা শহরে প্রবেশ করে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার পর ১১ই এপ্রিল ঈশ্বরদী থানার উদ্দেশে রওনা হয়। এদিনই বিকেল ৪টার দিকে তারা ঈশ্বরদীর কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তাদের যাত্রাপথের দুপাশে দাশুড়িয়া আলহাজ্ব মোড় ও জয়নগরে তখন আগুন জ্বলছিল। এলএমজি ও মর্টারের গোলার অবিরাম শব্দ ভেসে আসছিল। পাকসেনাদের মর্টার থেকে নিক্ষিপ্ত প্রথম গোলাটি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পশ্চিম পাশের বৈদ্যুতিক টাওয়ারে আঘাত হানে। ততক্ষণে পাকসেনারা পাকশী থেকে দুমাইল পূর্বে নতুন হাটে এসে গেছে। তারা রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর পোড়াতে-পোড়াতে আসছিল। এমতাবস্থায় পাকশী ও তার আশপাশের এলাকার মানুষ প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করলে জয়বাংলা বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য নদী পার হয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং নিয়ে ২৯শে জুন ঈশ্বরদী থানার প্রথম যে মুক্তিযোদ্ধা দলটি সাঁড়াঘাট হয়ে বাঘইল গ্রামে পৌঁছায় এবং ঈশ্বরদী থানার প্রত্যন্ত অঞ্চল কামালপুরে অবস্থান নেয়, তার নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুর রহিম টিনু, ফজলুল হক বুদু ও গোলাম রব্বানি। দলটিতে মোট ৩৩ জন সদস্য ছিলেন। আব্দুর রহিম ও ফজলুল হকসহ এ দলের অধিকাংশই ছিলেন জয়বাংলা বাহিনীর সদস্য। ট্রেনিংপ্রাপ্ত এসব মুক্তিযোদ্ধা ঈশ্বরদী থানার বেশকিছু অপারেশনে অংশ নিলেও তাঁদের প্রস্তুতিপর্বের বাহিনীর নাম আর কখনো ব্যবহার করেননি। এ বাহিনীর প্রধান দুজন উদ্যোক্তার মধ্যে কাজি সদরুল হক সুধা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত হন। তাঁর কোম্পানির নাম ছিল ‘আলফা’ এবং সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচু মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব পর্যায়ে ছিলেন। [আবুল কালাম আজাদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড