বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই জনযুদ্ধ
জনযুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ, ইংরেজিতে যাকে বলে People’s War। এতে কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মজুর, তাঁতি, নৌকার মাঝি, নারী, পুরুষ, গৃহিণী, ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বেসামরিক আমলা, বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড়ি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রবাসী বাঙালি, কূটনীতিক নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়েরও ছিল গভীর সহানুভূতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য বুঝতে হলে এর পটভূমি সম্বন্ধে ধারণা থাকা আবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে চূড়ান্ত পর্ব। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে বাঙালিকে এখানে পৌঁছতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক ধাঁচের শাসন- শোষণ, নিয়ন্ত্রণ ও জাতি-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে শুরু হয় তাদের নব পর্যায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম, ১৯৪৮ ও ৫২-র ভাষা-আন্দোলন-এর মধ্য দিয়ে যার সূচনা। ভাষা-আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্ত্বার ভিত্তিভূমি রচনা ও স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বাবোধকে বিকশিত করে। এর সঙ্গে অন্যান্য দাবিতে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সংগ্রাম বিশেষ করে ৬৬-র ৬-দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০- এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ : ৬ দফার পক্ষে বাঙালিদের গণম্যান্ডেট লাভ ও বঙ্গবন্ধুর বাংলা ও বাঙালির একমাত্র ‘মুখপাত্র’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া, নির্বাচনের রায় নস্যাৎ করতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ও জান্তার সহযোগী পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ ইত্যাদির ফলে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনার পূর্বেই বাঙালি জাতির বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটে। সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একাট্টা হয়। ইতিহাসে বাঙালিরা এরূপ ঐক্যবদ্ধ আর কখনো হয়নি। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭১ সালের ২-২৫শে মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-এর কর্মসূচি পালিত হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ব বাংলা পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধু পরিণত হন de facto সরকার প্রধানরূপে। এমনি এক পটভূমিতে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উদ্দেশে ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ বিক্ষোভে উত্তাল মহাজনসমুদ্রের সম্মুখে তাঁর দিকনির্দেশনাপূর্ণ ঐতিহাসিক ভাষণ (যা ইতিহাসে সাতই মার্চের ভাষণ- হিসেবে খ্যাত) নিয়ে হাজির হন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সেটি ছিল অন্তিম মুহূর্ত আর বাঙালির জন্য ছিল স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার এক মহালগ্ন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালিদের অবস্থা ব্যাখ্যা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরা, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা, সারা বাংলায় পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ সংগ্রাম শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন ইত্যাদি বক্তব্যের পর ঘোষণা করেন : ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট, যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
ইতোমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারিত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর স্পষ্টত সারা বাংলায় ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো সর্বত্র গড়ে ওঠে সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র-যুবকসহ মানুষজন ডামি বন্দুক ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত সীমিত অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করতে থাকে। একই সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলে।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিরদের ওপর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেস মেসেজের সাহায্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় বাঙালির ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদ-কে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত ৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকার(যা মুজিবনগর সরকার নামে সর্বাধিক পরিচিত)-এর নেতৃত্বাধীনে ঐ যুদ্ধ পরিচালিত এবং ডিসেম্বরের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার্স ও ছাত্রদের ছাত্রাবাস, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি, পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত শাঁখারি পট্টিসহ ঢাকা শহর ও দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা বাঙালিদের হতবাক ও প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ করে। একই সময় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে গেলে শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালির গণপ্রতিরোধ। বস্তুত ২৫শে মার্চের পূর্বেই জনতার প্রতিরোধের প্রস্তুতি সারাদেশব্যাপী চলে, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। স্মর্তব্য যে, ১৯শে মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহানজেব আরবাব একদল পাকিস্তানি সেনা সদস্যসহ ঢাকার অদূরবর্তী জয়দেপুর ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে অগ্রসর হলে জয়দেবপুর চৌরাস্তা মোড়ে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। সেখানে হানাদার বাহিনীর গুলিতে হুরমতসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ হতাহত হয়। ২৫শে মার্চ রাত থেকেই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তা কেটে বা খুঁড়ে, বড়বড় গাছ কেটে রাস্তার ওপর ফেলে, পুল-ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের এ প্রতিরোধ ভেঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীকে অগ্রসর হতে হিমসিম খেতে হয়। ফলে মধ্য-এপ্রিল পর্যন্ত দেশের বহু স্থান শত্রুমুক্ত থাকে। পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালি সেনা সদস্য, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সঙ্গে প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ লাঠিসোঁটা, দা, সড়কি, বল্লম, দেশী বন্দুকসহ, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী, ‘যার যা কিছু আছে’ তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে পাবনায় পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও তাদের বিতাড়িত করে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত তা মুক্ত রাখা (দ্রষ্টব্য পাবনা সদর উপজেলা), নগরবাড়িঘাটে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযোদ্ধাদের পাশাপাশি জনতার অংশগ্রহণ, মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩ দিনের প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া শহর হানাদারমুক্ত করা, (দ্রষ্টব্য কুষ্টিয়া সদর উপজেলা), ২৮শে মার্চ ছাত্র, জনতা, নারী-পুরুষ, এলাকার ওরাঁও-সাঁওতাল, পুলিশ, আনসার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মিলিত শক্তির রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ (দ্রষ্টব্য রংপুর সদর উপজেলা), নাটোরের লালপুরে স্থানীয় জনসাধারণ, নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-প্রচেষ্টা, দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএনএ, মানিক চৌধুরী এমএনএ এবং মেজর সি আর দত্ত, বীরবিক্রম-এর নেতৃত্বে ছাত্র, যুবক, স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে মৌলভীবাজার থেকে শুরু করে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে সেখানে যুদ্ধ শেষে কয়েকদিনের জন্য হলেও সিলেট শহর থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের তাড়িয়ে শহর নিজেদের দখল নেয়া ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কুষ্টিয়া হানাদারমুক্ত করার যুদ্ধে কয়েক হাজার জনতা বাঙালি প্রতিরোধযোদ্ধাদের পেছনে অবস্থান নিয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে শত্রুদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে এবং যুদ্ধে প্রচুর হতাহত ও চরম পর্যুদস্ত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রামের ভেতর দিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের সকলে গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয়। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণকালে স্থানীয় ওরাঁও ও সাঁওতালরা মন্ত্র পাঠ করে বুদু ওরাঁও-এর নেতৃত্বে তীর, ধনুক ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জনতার সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের তীরন্দাজ বাহিনী শত্রুর দিকে তীর নিক্ষেপ করতে-করতে সম্মুখে এগিয়ে যায়। অপরদিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের জনতার ওপর ভারী অস্ত্রের গোলা বর্ষণে অন্যান্যদের সঙ্গে ওরাঁও- সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। স্বাধীনতার পর রংপুর ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশ মুখে এক আদিবাসী যুবকের প্রতিকৃতিসহ অংশুমান – নামে একটি ভাস্কর্য এবং পাশাপাশি রক্ত গৌরব- নামে তীর-ধনুক আকৃতির অপর একটি স্মৃতিভাস্কর্য নির্মিত হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে জনতা কর্তৃক পাকিস্তানি দালালদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। দেশের বাইরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিরা একশন কমিটি গঠন করে সভা-সমাবেশের আয়োজন, প্রচারপত্র বিলি, পার্লামেন্ট সদস্য, কংগ্রেসম্যান ও পাকিস্তান এইড কনসর্টিয়াম সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গের নিকট লবিং ইত্যাদির মাধ্যমে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে (দ্রষ্টব্য প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা)।
বাঙালিদের প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধ মোকাবেলা শেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কয়েক মাসের জন্য সীমান্তবর্তী কতিপয় এলাকা ব্যতীত থানা পর্যায় পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। জুলাই মাসে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত এবং এর পর ৩টি রেগুলার ব্রিগেড গঠন, ভারতের প্রশিক্ষণ শিবিরসমূহে ছাত্র-যুবকদের বিপুল সংখ্যায় ট্রেনিং প্রদান শেষে দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার করার পূর্ব পর্যন্ত প্রধানত গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করা হয়। এর জন্য আবশ্যক হয় জনগণের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ ও তাদের সক্রিয় সহযোগিতা-সমর্থন। চীন বিপ্লবের (১৯৪৯) মহান নেতা মাও সে তুং-এর বিখ্যাত উক্তি স্মর্তব্য: ‘একজন গেরিলা হলো পানিতে মাছের মতো’, অর্থাৎ জনগণের মাঝে তার নিরাপদ আশ্রয় ও বিচরণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জনগণের অবস্থান ছিল ঠিক তদ্রূপ ও আদর্শ স্থানীয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সৃষ্ট স্থানীয় কিছু সংখ্যক রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটি-র দোসর-দালাল ব্যতীত সমগ্র জনগণ ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।
২৫শে মার্চ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলে হাজার-হাজার নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ প্রাণরক্ষার্থে প্রথম দিকে শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটে যায়। পথেপথে সাধারণ মানুষ তাদের শুকনো খাবার ও সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। কোথাও-কোথাও লোকজন তাদের জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র খোলে। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিশেষ টার্গেটে পরিণত হলে অনেক মুসলিম পরিবার তাদের আশ্রয় দেয়। পাকিস্তানি হানাদারদের হত্যা-নির্যাতনের কারণে দেশের অভ্যন্তরে টিকতে না পেরে মানুষ দলে-দলে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন এসব দেশত্যাগীদের খাবার ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে জনযুদ্ধ ছিল তার আর একটি প্রমাণ হলো, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সিংহভাগ ছিল কৃষক-শ্রমিক সাধারণ পরিবারভুক্ত। ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় বাহিনী গড়ে উঠেছিল, যেমন- কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, বাতেন বাহিনী, আকবর বাহিনী, রফিক বাহিনী, আফছার বাহিনী, অহিদুর বাহিনী, পলাশ ডাঙ্গা যুবশিবির- ইত্যাদি। নিতান্ত গরিব মানুষ পর্যন্ত তাদের পর্ণ কুটিরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, গৃহিণীরা রান্না করে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে, শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকারে ক্রলিং করে গিয়ে মানুষ শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছে, পথ চিনিয়ে দিয়েছে, অস্ত্র জমা রেখেছে, হানাদার বাহিনীর অবস্থান ও পরিকল্পনা সম্বন্ধে সংবাদ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে রংপুরের কুড়িগ্রামের অতি সাধারণ নারী তারামন বিবি, বীর প্রতীক, শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বানারীপাড়ার শোভা রাণী মণ্ডল, মাগুরার স্কুল শিক্ষিকা শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেন, পিরোজপুরের হুলারহাটের দিনমজুর শহীদ ভাগীরথী সাহা, চট্টগ্রাম শহরের হাজীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বিধবা নানীর বেপারীপাড়ার নির্জন বিলের মধ্যে অবস্থিত বাড়ি (যেখানে অপারেশন জ্যাকপট-এর ৪০টি লিমপেট মাইন ও অন্যান্য অস্ত্র এক রাতের জন্য রক্ষিত ছিল), রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার অধীন ৩নং বুড়িঘাট ইউনিয়নের ভাঙ্গামুড়ো গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দয়াল কৃষ্ণ চাকমা, কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শাহাদত বরণ (দ্রষ্টব্য শহীদ সাহাব উদ্দীন, বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠি এলাকার নারী মুক্তিযোদ্ধা শোভা রাণী মণ্ডল। পুরুষবেশে বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামের বিধবা যুদ্ধাহত নারী মুক্তিযোদ্ধা করুণা বেগম-এর যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শত্রুর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই, নেত্রকোনার দুর্গাপুর-এ নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটাতে উদ্যত দুই পাকিস্তানি সৈন্যকে দা-এর আঘাতে ঐসব নারী ও স্থানীয়দের কর্তৃক হত্যা, নদীতে নৌকার মাঝি কর্তৃক বৈঠা দিয়ে ডুবন্ত পাকসেনাদের হত্যা, ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে জনযুদ্ধে রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ নেতৃত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করলে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়। হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে চতুর্দিক থেকে ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার ঢল নামে। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড