ছয়গ্রাম গণহত্যা (ঈশ্বরদী, পাবনা)
ছয়গ্রাম গণহত্যা (ঈশ্বরদী, পাবনা) সংঘটিত হয় ২৫শে এপ্রিল। এতে বহু নিরীহ মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ই এপ্রিল থেকে ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ছয়গ্রাম গণহত্যা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের লক্ষ্মীকুণ্ডা, পাকুড়িয়া ও দাদাপুর, সাহাপুর ইউনিয়নের সাহাপুর ও মহাদেবপুর এবং পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর এই ছয়টি গ্রাম জুড়ে হত্যাকাণ্ড চালায়। পাকবাহিনীর এ হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করে ঈশ্বরদীর অবাঙালিরা। ছয়গ্রাম হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় বিহারিদের সঙ্গে বহিরাগত বিহারিরাও অংশগ্রহণ করে। উল্লেখ্য, সৈয়দপুর, সান্তাহার, নাটোর প্রভৃতি বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় থেকে বিহারি ও বাঙালিদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ শুরু হলে ঐসব এলাকার অনেক বিহারি নিরাপত্তার জন্য ঈশ্বরদীতে পালিয়ে এসেছিল। তারা এখানে স্থানীয় বিহারিদের আশ্রয়ে ছিল মূলত তারাই ছয়গ্রাম হত্যাকাণ্ডে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। মূল ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল সিরাজ, মাদারী, পাকড়ু, ইসমাইল, রফিক পাঞ্জাবি, মগলা ও আযম। এদের দলনেতা ছিল বিহারি নেসার চেয়ারম্যান।
২৫শে এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে পাকশী ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা দুটি দলে ভাগ হয়ে একদল ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ধরে সাহাপুরের দিকে অগ্রসর হয় এবং অপর দলটি রূপপুরের মাঝ দিয়ে পাকুড়িয়া হয়ে লক্ষ্মীকুণ্ডা গ্রামে এসে হাজির হয়। উভয় দলের সঙ্গেই ঈশ্বরদীর অবাঙালিরা যোগ দিয়েছিল। পাকসেনাদের আগমনের সংবাদে নিরীহ মানুষ প্রাণভয়ে বাবুলচরা, দীঘা, কামালপুর এবং চরকুড়ালিয়ার দিকে ছুটতে থাকে। অনেকে পদ্মানদী পাড় হয়ে কুষ্টিয়ার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল বারশবিঘায় আশ্রয় নেয়। যে- সকল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ পালাতে পারেননি, তারা হানাদারদের হত্যার শিকার হন। পাকসেনা ও অবাঙালিরা রূপপুর, সাহাপুর, পাকুড়িয়া, মহাদেবপুর, দাদাপুর ও লক্ষ্মীকুণ্ডা গ্রামে সারাদিন ধরে তাণ্ডব চালিয়ে বিকেল নাগাদ পাকশী ক্যাম্পে ফিরে যায়। ঐদিন রূপপুর গ্রামের আসগর ও দুজন অশীতিপর বৃদ্ধাসহ ১৩ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। দাদাপুর গ্রামের প্রায় ৪০-৫০ জন নর-নারীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পাকসেনারা হত্যা করে। লক্ষ্মীকুণ্ডা গ্রামের মুচিপাড়ার সমস্ত বাড়িঘরে আগুন দিয়ে তা ভস্মীভূত করা হয়। ‘কাফের নিধনে পুণ্য অর্জনের’ কথা বলে গ্রামের সমস্ত মুচিদের (হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত) নির্বিচারে হত্যা করা হয়। পাকুড়িয়া গ্রামের বৃদ্ধ স্কুল শিক্ষক উম্মেদ আলী মৌলবীসহ ১০-১২ জন নিরীহ গ্রামবাসী পাকসেনাদের হাতে নিহত হয়। সাহাপুরের গ্যাদা মিস্ত্রী ও আরশেদ, মহাদেবপুরের বদি খন্দকার ও তার ছেলেসহ অজ্ঞাতপরিচয় অসংখ্য মানুষের লাশে ছেয়ে গিয়েছিল ঐ ছয় গ্রাম। পাকহানাদার ও তাদের দোসর অবাঙালি বিহারিদের তাণ্ডবে ছয়গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর ভস্মীভূত হয় এবং পাকসেনাদের বর্বরতার শিকার হয় দুশতাধিক নর-নারী। [মো. ছাবেদ আলী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড