বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়দফা কর্মসূচি
ছয়দফা কর্মসূচি বাঙালির মুক্তিসনদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ব্যক্ত বাঙালির রাষ্ট্র-ধারণা ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ এবং ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান এক ছিল না। শুরুতেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক উর্দুভাষী শাসকগোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। অথচ সে-রাষ্ট্রে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ (শতকরা ৫৬ ভাগ)। রাষ্ট্রের রাজধানী, দেশরক্ষা বাহিনীসমূহের সদর দপ্তর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, কল- কারখানা, আমদানি-রপ্তানি, ব্যাংক-বিমা, বেসরকারি পরিবহণ ইত্যাদি পশ্চিম পাকিস্তানের বড়-বড় ব্যবসায়ী- শিল্পপতি পরিবারের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানাধীনে চলে যায়। পূর্ববাংলা (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান) সস্তা কাঁচামাল আর শ্রম সরবরাহ এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের পণ্যসামগ্রীর বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পূর্ববাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও এর সিংহভাগ ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। দু- অংশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে ভারসাম্য ছিল না, বাণিজ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে। নানা উপায়ে এ-অঞ্চল থেকে পুঁজি সেখানে চলে যেত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে- সঙ্গে পূর্ববাংলার সচিবালয় থেকে শুরু করে তৎকালীন মহকুমা পর্যন্ত সকল উচ্চপদে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারবৃন্দ আসীন হন। কেন্দ্রীয় প্রশাসনে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য তো ছিলই। এক কথায়, পূর্ববাংলার ওপর অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন (অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ) কায়েম হয়। বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়ায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো।
বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবি খুবই ন্যায়সঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও এজন্য বাঙালিদের শুধু আন্দোলন নয়, রক্ত পর্যন্ত দিতে হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ-কে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে পূর্ববাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় বটে, কিন্তু ঐ সরকারকে মাত্র ৫৬ দিন ক্ষমতায় থাকার পর অপসারণ করা হয়। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বেসামরিক শাসন আমলে পকিস্তানের ৮ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একমাত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ব্যতীত পূর্ববাংলা ও বাঙালির প্রতিনিধিত্বকারী আর কেউ ছিলেন না। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রাজনৈতিক নির্যাতনের পর ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাত্র ১৩ মাস ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পান। দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাঁর পরিকল্পনা আর কার্যকর হয়নি।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের সঙ্গে- সঙ্গে বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা-আমলাদের শাসন-নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ ও পাকাপোক্ত হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বাঙালিরা ছিল সর্বদা উপেক্ষিত। পরোক্ষ পদ্ধতির (নিম্নস্তর থেকে ধাপে-ধাপে ঊর্ধ্বস্তরে) তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের (১৯৫৯) আইয়ুবি ব্যবস্থায় বাঙালি রাজনৈতিক এলিটদের অংশগ্রহণের সব পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে, পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্য দিন-দিন বৃদ্ধি পায়। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। নানা কালাকানুন প্রবর্তিত হয়। সর্বোপরি, ১৯৬৫ সালে ১৭ দিন ব্যাপী ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বহির্বিশ্ব থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা বোধ এবং এ-ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্য বা অসহায়ত্ব প্রভৃতি ঘটনা বাঙালিদের দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
এদিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং দু-দেশের মধ্যে সম্পাদিত তাসখন্দ চুক্তি-উত্তর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের উদেশ্যে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে এক জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – (তখন তিনি পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি) ঐ কনভেনশনে যোগদান করেন। পূর্বে উল্লিখিত তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তিনি সেখানে পূর্ববাংলার জনগণের দাবি হিসেবে ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ খ্যাত তাঁর ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি পেশ করেন। কিন্তু আলোচনার জন্য কনভেনশনের সাবজেক্ট কমিটি তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে তিনি ঐ কনভেনশনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেন। তাঁর ৬-দফা কর্মসূচি ছিল সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
দফা – ১ : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা। সেখানে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকবে। সকল নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্ত-বয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে।
দফা – ২ : কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় বিষয় এ দুটি ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (তখন প্রদেশ) হাতে ন্যস্ত থাকবে।
দফা – ৩: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করা হবে। সে অনুযায়ী মুদ্রা ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের পরিবর্তে আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাঙ্ক থাকবে।
অথবা
ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হতে পারে। একই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এবং দুই অঞ্চলে দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
দফা – ৪ : সর্বপ্রকার ট্যাক্স-খাজনা-কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা ফেডারেল সরকারের পরিবর্তে আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। রাজ্য সরকার কর্তৃক এরূপ অর্থ আদায়ের সঙ্গে- সঙ্গে এর নির্দিষ্ট একটি অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হবে এবং সে অর্থ দ্বারা কেন্দ্ৰীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহ হবে।
দফা – ৫ : বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের পৃথক-পৃথক হিসাব রাখা হবে। এরূপ অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্ব-স্ব অঞ্চলের বা অঙ্গরাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকবে ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারে আদায় হবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আদান-প্রদান হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন এবং আমদানি-রপ্তানি করার সাংবিধানিক অধিকার আঞ্চলিক সরকারের থাকবে।
দফা – ৬ : পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য মিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গঠনের ব্যবস্থা, অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর এখানে স্থানান্তর করতে হবে।
বিরোধী দলের ঐ কনভেনশনে ৬-দফা প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তা নিয়ে জনগণের দরবারে হাজির হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর পূর্বে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি তাঁর ৬-দফা প্রস্তাব এবং তা বাস্তবায়নে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এরপর শুরু হয় তাঁর ব্যাপক গণসংযোগ। ২৫শে ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ৬ দফা কর্মসূচি তুলে ধরেন। এরপর ১৮-২০শে মার্চ ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ডেকে তিনি এ-কর্মসূচি অনুমোদন করিয়ে নেন। একই কাউন্সিলে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। কাউন্সিল অধিবেশনের শেষের দিন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ৬ দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। মঞ্চের কতিপয় পোস্টার ছিল নিম্নরূপ-
মধ্য-ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় তিন মাস একটানা গণসংযোগ অভিযানকালে তিনি পূর্ববাংলার জেলা ও
মহকুমা পর্যায়ে লক্ষ-লক্ষ লোকের সমাবেশে তাঁর ৬- দফা কর্মসূচি সবিস্তারে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘জেল- জুলুম ও নির্যাতন সম্পর্কে সচেতন হইয়াই ৬-দফা দাবী ঘোষণা করেছি।’ ৬-দফা দাবি নিয়ে সারা দেশে ঝাঁপিয়ে পড়া ও ঘরে-ঘরে পৌছে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এ দাবী সস্তা রাজনৈতিক শ্লোগান নয়’, ‘৬-দফা বিনিময়যোগ্য বস্তু নয়’, ‘৬-দফা রাজনৈতিক দরকষাকষির কোন ব্যাপার নয়’, ‘ইহার সহিত জড়িত বাঙালির জীবন-মরণ প্রশ্ন।’ তিনি ঘোষণা করেন, ‘৬-দফা প্রশ্নে কোন আপোষ নাই, যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে দাবী আদায় করা হইবে।’ এ কর্মসূচির ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু গণভোট অনুষ্ঠানেরও দাবি তোলেন। অতি দ্রুত সর্বত্র ৬-দফার পক্ষে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে এ সময়ে তাঁকে আটবার গ্রেপ্তার কখনো সিলেটে, কখনো ময়মনসিংহে, কখনে আবার কখনো নারায়ণগঞ্জে।
৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং এর সমর্থনে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ব্যাপক গণসংযোগ ও জনসমর্থন লাভ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তোলে। জেনারেল আইয়ুব কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে একে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’, ‘ধ্বংসাত্মক’, ‘বিদেশী মদদপুষ্ট’, ‘বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে এর প্রবক্তা মুজিব ও ৬-দফাপন্থীদের বিরুদ্ধে ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি দেন। ৬-দফা প্রচারে আর সময় না দিয়ে ৮ই মে নারায়ণগঞ্জের জনসভা শেষে ঢাকায় ফিরে এলে রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাবন্দি করে রাখেন।
এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন ৬-দফার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত ও বঙ্গবন্ধুসহ গ্রেপ্তারকৃত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের আহ্বানে সমগ্র পূর্ববাংলায় সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে পুলিশের গুলিতে ঢাকা, টঙ্গি ও নারায়ণগঞ্জে ১৩ ব্যক্তি নিহত হন। শত-শত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। ন্যাপের প্রচারপত্রে ৭ই জুনের বিবরণ ছিল এই রকম: ‘পাকিস্তানের জীবনেতিহাসে এমন হরতাল আর দেখা যায় নাই। পিকেটিংয়ের প্রয়োজন হয় নাই, স্বেচ্ছা-সেবকের কথা কেউ চিন্তাও করে নাই- তবুও ৭ই জুন ভোরবেলা দেখা গেল লক্ষ জনতা নিজেরাই স্বেচ্ছাসেবক, চোখেমুখে তাদের দৃপ্ত শপত, আত্মশক্তিতে গভীর আস্থা-কোনও ভ্রুকটি, কোনও চণ্ডনীতিই তাহাদিগকে টলাইতে পারিবে না।’ মানুষ হত্যা আর সরকারি জুলুম- নির্যাতনের প্রতিবাদে ৮ই জুন দৈনিক সংবাদের প্রকাশনা বন্ধ থাকে। ৯ই জুন প্রথম পৃষ্ঠায় ‘আমাদের নীরব প্রতিবাদ’ শিরোনামে বক্তব্যসহ পত্রিকাটি বের হয়। এতে বলা হয়:
এভাবে আইয়ুব সরকারের জেল-জুলুম ও হত্যা-নির্যাতন ৬- দফা আন্দোলনে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটায়। সভা-সমাবেশ, ধর্মঘট, পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে ৬-দফা কর্মসূচি পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে আরো ব্যাপকভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা তাদের বাঁচার দাবিতে পরিণত হয়। এরই এক পর্যায়ে ১৯৬৮ সালে আইয়ুব সরকার বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক মামলা দায়ের করে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে ও তাঁর ৬-দফা আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত হয় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬-দফার ভিত্তিতে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে এর পক্ষে গণম্যান্ডেট লাভ করে।
৬-দফা ‘রাজনৈতিক দর-কষাকষির’ কোনো বিষয় ছিল না। এর মর্মে ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর ভিত্তিমূলে আঘাত হেনে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার চেতনা। ৬-দফা ছিল বাঙালির মুক্তিসনদ বা ম্যাগনাকার্টা। ৬-দফা কেন্দ্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
সহায়ক গ্রন্থ: শেখ মুজিবুর রহমান, ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ ৬ দফা কর্মসূচী (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬), হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৮২; হারুন-অর-রশিদ, ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ ৬- দফার ৫০ বছর, বাংলা একাডেমি ২০১৬
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড