চৌহালী থানা অভিযান (চৌহালী, সিরাজগঞ্জ)
চৌহালী থানা অভিযান (চৌহালী, সিরাজগঞ্জ) পরিচালিত হয় মে মাসের শেষদিকে। এতে নেতৃত্ব দেন টাঙ্গাইলের বাতেন বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন-। বাতেন বাহিনীর টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলা ও চৌহালীর ভিন্ন পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধারা এ অভিযানে অংশ নেন। চৌহালী থানায় পাকহানাদার বাহিনীর কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় তাদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা এসে চৌহালীর বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালাত। তবে মাঝে-মাঝে তারা চৌহালী থানায় অবস্থান করত। থানায় অবস্থান করে তারা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম ও বাজারে লুণ্ঠন চালাত এবং অগ্নিসংযোগ করত। মে মাসের শেষদিকে নাগরপুর থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্রসহ হানাদার বাহিনীর একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত এবং নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতে চৌহালীতে আসে। তারা থানায় বাংকারও তৈরি করে।
বাতেন বাহিনী খবর পায় যে, চৌহালীর একটি গ্রামে ১৫ পেটি চাইনিজ এলএমজি এবং রাইফেলের প্রচুর গুলি আছে। তাঁরা এ বিপুল অস্ত্রের দখল নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন একটি বড় ছিপ নৌকায় বেশকিছু দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নিয়ে চৌহালীর দিকে যাত্রা করেন। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ধলেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে যমুনা নদী হয়ে তাঁরা চৌহালী থানার উপকণ্ঠে পৌঁছান। ছিপ নৌকাটি থামিয়ে বাহিনীর ২০ জন যোদ্ধাকে গুলি উদ্ধার করার জন্য পাঠানো হয়। অধিনায়কসহ মাত্র ৫ জন নৌকায় অবস্থান করেন। হঠাৎ আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় তাঁরা দেখতে পান যে, তাঁদের অবস্থান থানা থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে। থানার এত কাছে অপেক্ষা করা নিজেদের জন্য বিপদজ্জনক, আবার মাত্র ৫ জনের পক্ষে বিরূপ প্রাকৃতিক অবস্থায় ছিপ নৌকা চালিয়ে নিরাপদ অবস্থানে যাওয়াও ছিল দুষ্কর। এ অবস্থায় অধিনায়ক থানার হানাদার বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেন। নায়েক আজহার অধিনায়কের নির্দেশ মোতাবেক ক্রলিং করে থানার ভেতরে প্রবেশ করেন। তিনি থানার সামনে দুটি বাংকার দেখতে পান, যা বৃষ্টির পানিতে ভরা। কোনো সেন্ট্রি নেই। থানায় অবস্থানরত হানাদার সৈন্যরা ঘুমে নিমগ্ন। অধিনায়ক থানার এ অবস্থা শুনে মাত্র ৪টি অস্ত্র এবং ৪ জন যোদ্ধা নিয়ে থানা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। ৪ জন দুঃসাহসী যোদ্ধা ক্রলিং করে শূন্য বাংকার অতিক্রম করে থানার মূল বারান্দায় উপস্থিত হন। সেখানে তখন দুজন সেন্ট্রি ঘুমাচ্ছিল। মুখ চেপে ধরে ঐ দুই সেন্ট্রিকে সরিয়ে আনা হয়। তাদের কাছ থেকে নিশ্চিত হন যে, ভেতরে সবাই ঘুমিয়ে আছে। অধিনায়কের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁরা স্ট্রং রুম থেকে ১১টি থ্রি-জি-থ্রি এবং ১২টি থ্রি-ও-থ্রি রাইফেল, মার্কফোর-সহ প্রচুর গোলাবারুদ দখল করেন। অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে তাঁরা ছিপ নৌকায় ফিরে আসেন। নৌকা নিয়ে যমুনার উজান বেয়ে কিছুদূর অগ্রসর হলে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা চৌহালীর গ্রাম থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গুলির পেটিসহ এসে নৌকায় উপস্থিত হন। এর কয়েক মিনিট পর চৌহালী থানা থেকে হানাদার সৈন্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ইতোমধ্যে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যান। মাত্র ৪টি রাইফেল ও ৪ জন যোদ্ধা নিয়ে একটি থানা আক্রমণ অধিনায়কের জন্য খুবই দুঃসাহসিক অভিযান ছিল। [মো. শাহিন আলম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড