চিলমারী ঘাট ও রেলস্টেশন বধ্যভূমি (চিলমারী, কুড়িগ্রাম)
চিলমারী ঘাট ও রেলস্টেশন বধ্যভূমি (চিলমারী, কুড়িগ্রাম) কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদাররা এখানে বহু মানুষকে হত্যা করে। কুড়িগ্রাম জেলার বৃহত্তর নদী বন্দর চিলমারী। তখন চিলমারী রেলস্টেশন ও চিলমারী নদী বন্দর কাছাকাছি ছিল। এ নদী বন্দরে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। বন্দরের বড়বড় পাট গুদামে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে ভারত এবং পূর্বদিকে রৌমারী, দক্ষিণে গাইবান্ধা ও বাহাদুরাবাদ ঘাটের সঙ্গে যোগাযোগের মূল পথ ছিল চিলমারী। এ পথ দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচল করত। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের চোখে যাত্রীবাহী নৌকা পড়লেই স্পিডবোটে করে গিয়ে তারা নৌকাগুলো আটক করে যাত্রীদের মালামাল, অর্থ ও সোনা লুট করত। যাত্রীদের মধ্যে ছাত্র-যুবকদের ধরে চিলমারী ঘাটে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করত। নারীদের আটকে রেখে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। নদীর ঘাটে তারা অনেক মানুষকে হত্যা করে। এভাবে চিলমারী রেলস্টেশন ও বন্দর ঘাট বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। রংপুর ও কুড়িগ্রাম থেকে ট্রেনে বন্দি করে আনা মানুষদের হত্যা করে রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ক্যানেল ও রেললাইনের পাশের ডোবায় ফেলে দেয়া হতো। ১৭ই অক্টোবর চিলমারী যুদ্ধ-এ রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য বালাবাড়ি রেলস্টেশনে নিহত হয়। দালাল শামসুল হক পঞ্চ মিয়া ও অলি মোহাম্মদকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে রৌমারীতে নিয়ে যান। সেখানে পরদিন তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ ঘটনার পর পঞ্চু রাজাকারের ছোট ভাই রাজাকার আজিজুল হক ভাটু সমগ্র চিলমারী থানায় বহু হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তার নেতৃত্বে পাকসেনা ও রাজাকাররা চিলমারী ঘাটের পাশে রমনা গুরাতি পাড়ার মনভোলা (পিতা হলধর), খৈমুদ্দিন (পিতা মঈনুদ্দিন), মফিজ উদ্দিন (পিতা ভেংরা শেখ), ফুল মিয়া (পিতা মো. আলী), আবু জেয়াদ (পিতা মেন্দল), আব্দুস ছাত্তার (পিতা খুকু শেখ), টেপু শেখ (পিতা নাজির উদ্দিন), রফিয়াল (পিতা নেছার), মেহের আলী (পিতা দলে সরকার), গেল্লা শেখ, গেল্লা গাড়িয়াল (পিতা ইউছুব পানাতি), আজগার আলী (পিতা ইউছুব পানাতি), ছলি শেখ, মারুয়া ফকির, মহিজুদ্দিন (পিতা মইনুদ্দিন) ও নছিবুল্ল্যাহ দেওয়ানী (পিতা রহমুতুল্ল্যাহ)-কে হত্যা করে। চিলমারী যুদ্ধের দিন চাকলিরপাড় গ্রামের আবুল হোসেন, তার ৫ বছরের ছোট মেয়ে আফিয়া খাতুন, পচু ডাকাতের মা এবং রমনা পানাতি পাড়ার আজিজুর রহমান ও তার স্ত্রী লতিফন নেছা নিহত হন। চিলমারী যুদ্ধের দুদিন পর পাকসেনারা বৈলবৈন্দিয়ার মশিউর রহমান সদা ব্যাপারী (পিতা মহিজউদ্দিন ব্যাপারী), সারওয়ার হোসেন, নুরুদ্দিন (পিতা নূর হোসেন ব্যাপারী) ও নূর ইসলাম লেচুকে হত্যা করে। এছাড়াও নয়ান হাজীর গ্রামের (খলখড়িয়া), আহাব্বর হোসেন (পিতা পানাউল্লা সেখ), বালাজান খরখড়িয়ার আব্দুল লতিফ (পিতা নজমুদ্দিন), দুলাল (পিতা আব্দুল করিম), সাহের বানু (পিতা মিয়াজ উদ্দিন), ঝাউবাড়ী গ্রামের আবুল কাশেম (পিতা জহর আলী), নিরাশা (পিতা জহর আলী), মধ্যপাড়া রমনার দেলোয়ার হোসেন (পিতা গেন্দলা মামুদ) ও চাকলিরপাড়ের আইজলকে হত্যা করে। এসব শহীদের মধ্যে অনেকের লাশ চিলমারী ঘাট বধ্যভূমিতে পড়েছিল। অনেকের লাশ কুকুর-শৃগাল-শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়। কারো-কারো লাশ ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে ভেসে যায়। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড