চিকনিকান্দি গণহত্যা (গলাচিপা, পটুয়াখালী)
চিকনিকান্দি গণহত্যা (গলাচিপা, পটুয়াখালী) সংঘটিত হয় মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার অন্তর্গত চিকনিকান্দি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। ৮ই মে থেকে এ হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। ২৬শে এপ্রিল পটুয়াখালী সদর পাকবাহিনীর দখলে চলে গেলে পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত চিকনিকান্দি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এ খবর জানতে পেরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির লোকজন ৮ই মে দুটি গানবোট ও কয়েকটি লঞ্চ নিয়ে একযোগে হামলা চালায়। তারা ৭-৮দিন পর্যন্ত এখানে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। নির্বিচারে মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র চালিয়ে অগণিত মানুষকে হত্যা করে। চিকনিকান্দি বন্দরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শান্তি রঞ্জন দাসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে নিকটস্থ নদীতে ফেলে দেয়। এতে নেতৃত্ব দেয় রাজা সলিমুল্লাহ ও তার তিন ছেলে রাজা সাহাবুদ্দিন, রাজা আনসার উদ্দিন ও রাজা বাহাউদ্দিন-সহ স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। জীবনের ভয়ে লোকজন পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। এরপর পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে স্থানীয়রা শহীদদের লাশ উত্তর সুতাবাড়িয়া গ্রামের বিমল সমাদ্দারের বাড়ির পুকুরের পূর্বপাড়ে ও কুণ্ডুপাড়া গ্রামের ঠাকুর বাড়ির পুকুরের দক্ষিণ পাশে কবর দেয়। অনেক শহীদের লাশ শেয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেলে।
চিকনিকান্দিতে যাদের গণকবর দেয়া হয়, তাদের কয়েকজন হলেন- প্রফুল্ল সন্যামত (পিতা যামিনী কান্ত সন্যামত; উত্তর সুতাবাড়িয়া, চিকনিকান্দি), শান্তি রঞ্জন দাস (পিতা নবদ্বীপ চন্দ্ৰ দাস, চিকনিকান্দি), সোনাই রাণী সমাদ্দার (স্বামী বিমল সমাদ্দার, উত্তর সুতাবাড়িয়া), কালী প্রসন্ন সমাদ্দার (পিতা অভয় সমাদ্দার), পারুল বালা (পিতা কালীপ্রসন্ন সমাদ্দার), বাসন্তি রাণী বসু (স্বামী বঙ্কিম বসু), নিরঞ্জন গাঙ্গুলী (পিতা হীরালাল গাঙ্গুলী), কণক প্রভা (স্বামী নিরঞ্জন গাঙ্গুলী), অণিমা গাঙ্গুলী (পিতা নিরঞ্জন গাঙ্গুলী), দুলাল দাস (পিতা শচীন্দ্ৰ দাস), সত্যরঞ্জন দাস (পিতা শশীকান্ত দাস), জগদীশ দাস (পিতা সত্যরঞ্জন দাস), রাসবিহারী দাস (পিতা যোগেন্দ্ৰ দাস), সুমিত্রা রাণী দত্ত (পিতা বিশ্বেশ্বর দত্ত), নিলু দাস (পিতা মনোরঞ্জন দাস), বিদ্যা রাণী দাস (স্বামী ললিতমোহন দাস), সাবিত্রী রাণী দত্ত (স্বামী চন্দ্রকান্ত দত্ত), নারায়ণ কুণ্ডু (পিতা বনমালী কুণ্ডু, মাঝগ্রাম), লক্ষ্মণ কুণ্ডু (পিতা নারায়ণ কুণ্ডু), মাখন কুণ্ডু (পিতা অম্বিকা কুণ্ডু), সুশীল কুণ্ডু (পিতা নারায়ণ কুণ্ডু), উমাচরণ নাথ (পিতা প্রসন্ন চন্দ্ৰ নাথ, চিকনিকান্দি), শ্রীকান্ত দেবনাথ (পিতা নিশিকান্ত দেবনাথ, পাড়ড়াকুয়া),অরুণ কুণ্ডু (পিতা গোপীনাথ কুণ্ডু, পটুয়াখালী শহর), তাঁর দুই বছরের শিশুপুত্র, ক্ষেত্রমোহন দেবনাথ (পিতা মদনমোহন দেবনাথ, গলাচিপা শহর), মন্টু কুণ্ডু (পিতা লক্ষ্মী কুণ্ডু, মাঝগ্রাম), সুবল কুণ্ডু (পিতা সত্যরঞ্জন কুণ্ডু), সুদেব কুণ্ডু (পিতা নারায়ণ কুণ্ডু), নিমাই পাল (পিতা চন্দ্রবিনোদ পাল), রমণী সাহা (পটুয়াখালী শহর), বিমল ভুঞ্জমালী (পিতা মনোরঞ্জন ভুঞ্জমালী, উত্তর সুতাবাড়িয়া) এবং সুকুমার রঞ্জন দাস (বেতাগী সানকিপুরা, দশমিনা) এবং মনোহর মণ্ডল (ঐ)।
পাকসেনারা গলাচিপা শহর থেকে ধরে নিয়ে পটুয়াখালী জেলখানায় স্থাপিত নির্যাতন ক্যাম্পে যাদের হত্যা করে, তারা হলেন— নিরঞ্জন বিশ্বাস (পিতা শরৎ চন্দ্র বিশ্বাস), রাধিকা মোহন সাহা (পিতা রাইচরণ সাহা), রাধেশ্যাম কুণ্ডু (পিতা অনুকূল চন্দ্র কুণ্ডু), সুভাষ চন্দ্র দাস (পিতা বিনোদ বিহারী দাস; মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ নেতা গোপাল দাসের সঙ্গে লঞ্চযোগে পটুয়াখালী গেলে সেখানে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং নির্যাতনের পর দুজনকেই হত্যা করা হয়) এবং বাসুদেব পাল (পিতা ননীগোপাল পাল)। [মশিউর রহমান বাবুল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড