You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে চাটমোহর উপজেলা (পাবনা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে চাটমোহর উপজেলা (পাবনা)

চাটমোহর উপজেলা (পাবনা) ভাষা-আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও তৎপরবর্তী সকল আন্দোলনে চাটমোহরবাসীর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা ব্যালটের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দেয়। তাই নির্বাচনে চাটমোহর থেকে আওয়ামী লীগ-এর মনোনীত প্রার্থী সৈয়দ হোসেন মনসুর এবং অধ্যক্ষ মোজ্জাম্মেল হক সমাজী বিপুল ভোটে যথাক্রমে এমএনএ ও এমপিএ নির্বাচিত হন। সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর ফলে সারা দেশের মানুষের মতো চাটমোহরবাসীরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। চাটমোহরবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ আন্দোলনে যোগ দেয়। নারীরাও এতে অংশগ্রহণ করেন। ডা. জয়নুদ্দিনের কন্যা হীরা ও গুনাইগাছার শচীন্দ্রনাথ ভৌমিকের স্ত্রী লক্ষ্মীরাণী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। উপজেলার ছাত্র-শিক্ষকগণ শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। অবিরাম মিটিং-মিছিল চলতে থাকে। প্রতিবাদী জনতা বাঁশের লাঠি, ঢাল-সড়কি, লোহার রড, গাছের ডাল ইত্যাদি নিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। তাদের হাতে শোভা পায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের পতাকা। থানার গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিসসমূহ বন্ধ থাকে। এরূপ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের ইঙ্গিত পেয়ে চাটমোহরের নেতৃবৃন্দ জনগণকে সংগঠিত করেন। জনগণ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী বাঙালিদের দাবি-দাওয়া পুরোপুরি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ নেয়। সভা-সমাবেশ ও মিছিলের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করার চেষ্টা করা হয়। এভাবে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আন্দোলন চলে, পাশাপাশি চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে প্রত্যেক গ্রাম ও মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজী এমপিএ- কে প্রধান করে চাটমোহরে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা ছিলেন- মোজাম্মেল হক ময়েজ, ইসমাইল মাস্টার, গৌরচন্দ্র সরকার (গৌর মাস্টার), মো. মহররম হোসেন, মাহতাব উদ্দিন চাঁদু, আজিজুল হক, শের মাহমুদ, আলী আকবর, আবুল কাশেম, শরাফত উল্লাহ (পোস্ট মাস্টার) প্রমুখ। কমিটি মিটিং-মিছিল পরিচালনা করে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিনিধি পাঠিয়ে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে জনমত গঠন করে। বিভিন্ন ইউনিয়নে আন্দোলন পরিচালনায় যাঁরা ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন- হান্ডিয়ালে মো. গোলজার হোসেন, গুনাইগাছায় আব্দুর রহিম, পার্শ্বডাঙ্গায় মো. বেলালুর রহমান বেল্লাল, ছাইকোলায় ময়েন সরদার প্রমুখ। মার্চের মাঝামাঝি পাবনা থেকে ছাত্রলীগ নেতা আব্দুস সাত্তার লালু চাটমোহরে এসে ডাকবাংলোতে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সে-সময় মোজাম্মেল হক ময়েজ, গৌর চন্দ্র সরকার, আবুল কাশেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ২১শে মার্চ অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজী এমপিএ- এর সভাপতিত্বে চাটমোহর হাইস্কুল প্রাঙ্গণে থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে তিনি সকলকে সর্বদা প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। মার্চের পর প্রতিটি ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে তরুণদের সংগঠিত করা হয়। চাটমোহরের বিভিন্ন ইউনিয়নে বিভিন্ন রকম স্লোগান ছিল তরুণদের উজ্জীবিত করার বড় হাতিয়ার। চাটমোহর সদরের স্লোগান ছিল— ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’। রেল বাজার থেকে শুরু করে দক্ষিণ চাটমোহরের গ্রামগুলো এ স্লোগানে মুখরিত থাকত। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব চাটমোহরের ছাইকোলা, হান্ডিয়াল ও নিমাইচরা ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে স্লোগান ছিল- ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলা – জেগেছে জেগেছে’, ‘সোহ্রাওয়ার্দীর বাংলা – জেগেছে জেগেছে’, ‘শেরে বাংলার বাংলা জেগেছে জেগেছে’।
চাটমোহর উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার থেকে মুক্তি এবং দেশমাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করার লক্ষ্যে অগণিত তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নিমিত্তে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। নানারকম প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তাঁরা চারঘাট থেকে নদী পাড় হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ যান। চাটমোহরের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এখানেই ট্রেনিং গ্রহণ করেন। প্রথমদিকে প্রশিক্ষণে অংশ নিতে স্থানীয় এমপিএ অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজীর সুপারিশ লাগত। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার শুরুর দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। তাদের সন্দেহ ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের বেশে সর্বহারারা ভারতে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তখন এমপিএ সমাজী দেশের অভ্যন্তরে ছিলেন। তাই প্রথমদিকে চাটমোহরের তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বেশ বেগ পেতে হয়। পরে যখন স্রোতের মতো অগণিত মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তখন আর স্থানীয় প্রতিনিধির সুপারিশের প্রয়োজন হয়নি।
চাটমোহর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমদিকে মুর্শিদাবাদে ট্রেনিং নিলেও পরবর্তীতে ভারতের নদীয়া এবং পশ্চিম দিনাজপুরে ট্রেনিং নেন। নদীয়ার ক্যাম্পের নাম ছিল বিধান রায় হাইস্কুল ক্যাম্প। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন পাবনা- ১২ আসনের এমপিএ মো.আব্দুর রব বগামিয়া। আর পশ্চিম দিনাজপুরের ক্যাম্পের নাম ছিল কুরমাইল ক্যাম্প। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন পাবনা-৫ আসনের এমএনএ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। পাবনা জেলার প্রথম তিনটি গ্রুপ প্রশিক্ষণ নেয় বিহার প্রদেশের সিংভূম জেলার চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে। ট্রেনিং- এর মেয়াদ ছিল ৩৮ দিন। এ- তিনটি গ্রুপের প্রতিটিতে চাটমোহরের ৫-৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রথমে মুক্তিবাহিনী এবং পরে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপেক্ষাকৃত সচেতন তরুণরা মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তাঁদের ট্রেনিং হতো উত্তর প্রদেশের দেরাদুনে। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ২৮ দিন। গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ৪ঠা আগস্ট চাটমোহরে প্রবেশ করেন।
অক্টোবর মাস থেকে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী চাটমোহর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে শক্তিশালী ক্যাম্প গড়ে তোলে। হরিপুর ইউনিয়নের গোপালপুর ক্যাম্পে প্রায় দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করতেন। ছাইকোলা, হান্ডিয়াল ও নিমাইচরা ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ঘাঁটি ছিল শীতলাই জমিদার বাড়ি। এ ঘাঁটিসহ হান্ডিয়াল বোর্ড অফিসের আঙ্গিনা ও গেদুমিয়ার বাড়িতে তরুণদের অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। গোলজার হোসেন, গেদুমিয়া ও খন্দকার আহেদ তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মো. মযহারুল ইসলাম কালু চরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, বোয়ালমারী স্কুল মাঠ, মথুরাপুর বাজার ও গুনাইগাছা বোর্ড অফিসে তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। রাত হলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দিক থেকে এলোপাতারি গুলি ছুড়তেন। ফলে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করতে পারত না। মুক্তিযোদ্ধারা টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সংযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দেন। এসব কারণে পাকসেনারা রাতের বেলা কোথাও বের হতো না।
চাটমোহর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকগণ হলেন— অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজী এমপিএ, ছাইকোলা গ্রামের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর সরকার, হরিপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমান খন্দকার এবং চাটমোহর মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মো. রইচ উদ্দিন সরকার। অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজী চাটমোহর সদর এবং তাঁর নিজ ইউনিয়ন নিমাইচরাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। আব্দুল গফুর সরকার দক্ষিণ চলন বিলের ছাইকোলা ও হান্ডিয়াল ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক ছিলেন। তিনি সারারাত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থাকতেন। আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমান খন্দকার নিজ বাগানবাড়িতে মুক্তিবাহিনীর জন্য ক্যাম্প গড়ে তুলেছিলেন। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন মো. রইচ উদ্দিন সরকার। তিনি এলাকার তরুণদের নিয়ে ১০-১২ জনের একেকটি দল গঠন করতেন এবং খুব ভোরে চাটমোহর থেকে রওনা হয়ে বনপাড়া যেতেন। পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রেখে বনপাড়ার কোনো এক হোটেলে অতিদ্রুত নাস্তা সেরে চারঘাটের দিকে রওনা হতেন। অতঃপর নৌকায় পদ্মা পার হয়ে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গীতে পৌঁছাতেন। এভাবে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিনি মোট পাঁচবার ভারতে যাওয়া- আসা করেছেন এবং চাটমোহর ও আশপাশের উপজেলার প্রায় ৫০-৬০ জন তরুণকে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে ভর্তি করিয়েছেন।
চাটমোহরের মুক্তিযোদ্ধারা আলাদা কমান্ডারের অধীনে বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন এস এম মোজাহারুল হক (সংখ্যা ৭৩ জন), মো. মোজাম্মেল হক ময়েজ (সংখ্যা ৩৩ জন), এ কে এম খায়রুজ্জামান গেদুমিয়া (সংখ্যা ২১ জন) এবং এম আই চৌধুরী (সংখ্যা ১৭ জন)। আর মুজিব বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন ওসমান গনি (সংখ্যা ১১ জন), মো. মযহারুল ইসলাম কালু (সংখ্যা ৮ জন), মো. রওশন আলী (সংখ্যা ১১ জন) এবং মো. গোলজার হোসেন (সংখ্যা ১০ জন)।
২৫শে মার্চের গণহত্যা এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর চাটমোহরে পৌঁছালে সমগ্র থানার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায়-রাস্তায় গাছপালা কেটে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চাটমোহরের প্রবেশ পথ চিকনাই নদীর ঘাটে দেশীয় অস্ত্র ও বন্দুক নিয়ে প্রতিরোধ ব্যূহ তৈরি করে পালাক্রমে পাহারা দেয়। ২৭শে মার্চ গুজব ছড়ায় যে, ঈশ্বরদী থেকে ট্রেনযোগে পাকসেনা চাটমোহর আসছে। এ খবর শোনামাত্র হাজার খানেক জনতা লাঠি, ফলা, বর্শা, হলঙ্গা, রামদা ইত্যাদি নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য রেলস্টেশনের দিকে রওনা হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা সারাদিন স্টেশনে অপেক্ষা করে। কিন্তু কোনো পাকসেনার দেখা পাওয়া যায়নি।
পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম নূরুল কাদের এবং পুলিশ সুপার মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র ধারণ করে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁদের নেতৃত্বে প্রতিরোধকারীরা পাবনা জেলাকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা ও সক্রিয় ভূমিকা পালনের কারণে চাটমোহরের সংগ্রামী জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণে বিপুলভাবে উৎসাহিত হয়। ২৯শে মার্চ ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিপুল সংখ্যক সৈন্য পাবনায় প্রবেশের চেষ্টা করলে পাবনা জেলার প্রতিরোধ যোদ্ধারা উত্তর বঙ্গের প্রবেশ পথ নগরবাড়িতে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় দুসপ্তাহ এখানে যুদ্ধ চলে। চাটমোহরের প্রতিরোধ যোদ্ধারা এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রনেতা হারুনের নেতৃত্বে চাটমোহরের যুব-কর্মীরা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহ করতে থাকেন। দেড়শ-র মতো পাকসেনা এ প্রতিরোধযুদ্ধে নিহত হয়।
১০ই এপ্রিল নগরবাড়ি পতনের পর পাবনার প্রতিরোধ যোদ্ধারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। পাকসেনারা পাবনায় প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাবনার পতনের পর চাটমোহরের প্রতিরোধ যোদ্ধারা বুঝতে পারেন হালকা অস্ত্র ও লাঠি-ফলা দিয়ে প্রশিক্ষিত পাকআর্মিকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাঁরা ভারতে যেতে থাকেন। পাবনা দখল করার ১৪ দিন পর ২৪শে এপ্রিল শনিবার পাকসেনারা চাটমোহরে প্রথম প্রবেশ করে। তারা ৬০-৭০ জন নিরীহ মানুষকে ধরে থানায় বন্দি করে রাখে। তারা প্রথমে অশ্বিনী কুমার কুণ্ডুর বাড়িতে হানা দেয় এবং তাকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। একই দিন ঝরু মাস্টার, রঘুনাথ কুণ্ডু, জগৎ কুণ্ডুসহ ৮ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। ঐদিন চাটমোহরে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়ে তারা চলে যায়। এর মাত্র তিনদিন পর ২৭শে এপ্রিল পুনরায় পাকসেনারা চাটমোহরে আসে এবং নতুন বাজারের জ্যোতিন্দ্রনাথ কুণ্ডুকে হত্যা করে। তৃতীয় দফায় ১৩ই মে তারা চাটমোহরে এসে ডাকবাংলোতে ক্যাম্প স্থাপন করে। বেলুচ ক্যাপ্টেন আরিফ ছিল ক্যাম্পের অধিনায়ক। জুন মাসে তারা রেলস্টেশনে একটি সাবক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকসেনারা ক্যাম্প স্থাপনের পর এলাকার পাকিস্তানপন্থী লোকদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করে। শান্তি কমিটির প্রথম চেয়ারম্যান ছিল ময়েন উদ্দিন মোল্লা (পিতা মনির উদ্দিন মোল্লা, বৃগুয়াখাড়া)। কিন্তু সে জুলুম নির্যাতনের বিরোধী হওয়ায় অল্পদিন পরে তাকে অপসারণ করে ফয়েজ আহমেদ খান (পিতা আকবর হোসেন খান, নতুন বাজার)-কে চেয়ারম্যান করা হয়। শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ছিল নূরুজ্জামান মোল্লা (পিতা নোনা মোল্লা, নারিকেল পাড়া) এবং সদস্য ছিল- মো. আব্দুল করিম (হাসুপুর), আফজাল খন্দকার (পাইকপাড়া), আশরাফ খন্দকার (পাইকপাড়া), দিদার হোসেন (চর এনায়েতপুর), আকবর আলী আকন্দ (হাসুপুর), আব্দুল জব্বার (হাসুপুর), নাজির উদ্দিন মণ্ডল (রায়নগর) ও রজব আলী ফকির (চর এনায়েতপুর)। এছাড়া এদের সহযোগী বেশ কয়েকজন বিহারিও ছিল। শান্তি কমিটির কাজ ছিল এলাকায় পাকিস্তানবিরোধী কোনো কার্যকলাপ যাতে না হয় সেটি দেখা এবং যুবকদের তালিকা তৈরি করে পাকআর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়া। কখনো-কখনো তারা নিজেরাই তরুণদের ধরে আর্মিক্যাম্পে নিয়ে যেত। কোনো তরুণকে সন্দেহ হলে ক্যাপ্টেন আরিফ কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে তাকে ভয়ভীতি দেখানো বা কথা আদায়ের চেষ্টা করত। অনেক সময় অবিভাবকদের ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিয়ে সন্তানদের ছাড়াতে হতো। বিহারি পুলিশরা এ টাকার ভাগ পেত।
পাকআর্মিদের সহযোগিতার জন্য চাটমোহরে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও গঠন করা হয়। রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ছিল- মো. আকবর আলী মোল্লা (পিতা মহির উদ্দিন মোল্লা, ভেংরী; সংগঠক), ইয়াকুব মুন্সী (পিতা সাহেব আলী, ছোট শালিখা; কমান্ডার), মোত্তালেব হোসেন ফালু (পিতা মো. পিয়ার আলী, আফ্রাতপাড়া; কমান্ডার), মো. পাঞ্জাব আলী (খৈবাশ), আব্দুল মতিন মতি (নতুন বাজার), জয়নাল হোসেন জয়না (আফ্রাতপাড়া), নজির উদ্দিন সরকার (বল্লভপুর), আব্দুল কুদ্দুস আকন্দ (হাসুপুর), আকরাম শেখ (নতুন বাজার), মো. শাহজাহান (নারিকেল পাড়া), আব্দুল মালেক (নারিকেল পাড়া), আফতাব উদ্দিন (মধ্য শালিখা), আব্দুর রাজ্জাক (ছোট শালিখা), ওসমান গণি (ছোট শালিখা), আব্দুল কুদ্দুস (বড় সিংগা), আতিয়ার রহমান (বালুচর), উম্বর খলিফা (বড় সিংগা), মো. কয়ছের উদ্দীন (বড় সিংগা), আব্দুস ছাত্তার (জাবরকোল), সেকেন্দার আলী (দোলং), আরশেদ আলী (দোলং), আবুল হোসেন (আগশুয়াইল), মো. সেরাজ উদ্দিন (দোলং), আধজের মোল্লা (নারিকেল পাড়া), তারা মিয়া (দোলং), ওসমান গণি (দোলং), মো. আরশেদ আলী (বল্লভপুর), আজিম (জাবরকোল) এবং আবুল কাশেম (আফ্রাতপাড়া)।
আলবদর বাহিনীর সদস্যরা হলো- সাবান মল্লিক (পিতা সোনাই মল্লিক, পাঁচুরিয়া; কমান্ডার), তোরাব আলী (রামচন্দ্রপুর), আকবর আলী গুন্ডা (নারিকেল পাড়া) প্রমুখ। স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ-এর শীর্ষনেতারা হলো- মোহসীন সরকার (পিতা হাজী মহিউদ্দিন সরকার, ছাইকোলা; ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এমপিএ প্রার্থী ছিল), মির্জা আব্দুল কাদের (মধ্য শালিখা) এবং মো. আখতারুজ্জামান (ছাইকোলা) প্রমুখ। উল্লিখিত ব্যক্তিদের অধিকাংশ স্বাধীনতার পরে দালাল আইনে গ্রেফতার হয় (কেস নং- ২,৩,৪/১৯৭৩, জজকোর্ট, পাবনা) এবং আদালতের রায়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।
পাকবাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের আগে ২৪শে এপ্রিল এবং ২৭শে এপ্রিল চাটমোহরে এসেই হত্যাকাণ্ড শুরু করে। মে মাসে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের পর শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ফয়েজ আহমেদ খান জোরপূর্বক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ধর্মান্তরিত করে। সংখ্যালঘুদের ওপর চলতে থাকে জুলুম ও অত্যাচার। শান্তি কমিটির সেক্রেটারি নূরুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে রাজাকাররা গ্রামে-গঞ্জে চালাতে থাকে অত্যাচার, নির্যাতন ও লুটপাট। অবাঙালিরা এবং এলাকার লুটেরা বাহিনী পাকসেনাদের দোসর হিসেবে কাজ করে। চাটমোহর থানার ত্রাস সৃষ্টিকারী আকবর আলী গুন্ডা লুটপাটে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অনেক হিন্দুবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। চাটমোহরের অনেক হিন্দু বনপাড়া, জোনাইল ও রাজশাহীর আঁধার কৌঠা খ্রিস্টান মিশনে আশ্রয় নেয়। প্রাণে বাঁচার জন্য তারা খ্রিস্টানদের পোশাক পরিধান করত। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় এক পর্যায়ে নিরীহ জনগণ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যায়। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে শচীন্দ্রনাথ ভৌমিক শহীদ হন। যুদ্ধের শেষেদিকে ছাইকোলা গ্রামের গুমানী নদীতে পাকবাহিনীর বোমারু বিমানের বোমার আঘাতে নৌকাডুবিতে একজন এবং রাজাকারের গুলিতে একই গ্রামের আবদুল নামে একজন নিরীহ ব্যক্তি নিহত হয়।
পাকবাহিনী ডাকবাংলো 3 রেলস্টেশন ক্যাম্পকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। এলাকার সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও তরুণদের এ-দুটি ক্যাম্পে ধরে এনে অত্যাচার করা হতো। পাকআর্মিদের হাতে নারীনির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। এলাকার রাজাকাররা এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা করত।
মুক্তিযোদ্ধারা চাটমোহরে প্রবেশ করে আগস্ট মাসের প্রথমদিকে চাটমোহর রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন সাবক্যাম্পে পাহারারত পাকসেনা ও রাজাকারদের ওপর গেরিলা আক্রমণ চালান। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেই নিরাপদ স্থানে চলে যান, তাই তাঁদের কেউ হতাহত হননি। তবে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে পড়ে একজন কিশোরসহ দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন। এ-যুদ্ধে ওসমান গণি, ইদ্রিস আলী চঞ্চল, মো. আজাহার আলী ও মো. আইনুল হকসহ অনেকে অংশগ্রহণ করেন।
এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধারা আরো অপারেশন ও যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তালগাছী বিদ্যুৎ টাওয়ার অপারেশন এর একটি। এটি পরিচালিত হয় ১৩ই আগস্ট। ১৪ই আগস্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। চাটমোহরের গেরিলা কমান্ডার এস এম মোজাহারুল ইসলাম তাঁর বাহিনী নিয়ে পরিকল্পনা করেন পাকবাহিনী যাতে জাঁকজমকের সঙ্গে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে না পারে সেজন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। তাই ১৩ই আগস্ট তাঁর নেতৃত্বে ৫-৭ জন গেরিলা যোদ্ধা উল্লাপাড়ার অন্তর্গত তালগাছীর ৩৩ হাজার ভোল্টের গ্রিড লাইনের টাওয়ারটি উড়িয়ে দেন। ফলে পাবনা ও বগুড়া অন্ধকার হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে পাকসেনারা আসার আগেই গেরিলারা নিরাপদে চাটমোহরে ফিরে আসেন।
বড়াল ব্রিজ রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন ছিল অপর একটি। এটি পরিচালিত হয় ২১শে আগস্ট। এ ক্যাম্পে ৪০ জন রাজাকার থাকত। তাদের মধ্যে ৫ জনের হাতে অস্ত্র থাকত। বাকিরা লাঠিহাতে ব্রিজ পাহারা দিত। কমান্ডার এস এম মোজাহারুল ইসলাম তাঁর বাহিনী নিয়ে ২১শে আগস্ট ক্যাম্পটি আক্রমণ করেন। রাজাকাররা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা রাত ৯টার দিকে ভাঙ্গুড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন ঘেরাও করেন। অপারেটর কোবাদ হোসেন গেরিলাদের সহযোগিতা করেন। গেরিলারা টেলিফোন অফিসের যন্ত্রপাতি মহেলা গ্রামে নিয়ে আসেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কোবাদ হোসেনের সহযোগিতায় টেলিফোন অফিসটি ভাঙ্গুড়াতে পুনঃস্থাপিত হয়।
২৮শে আগস্ট পরিচালিত হয় কৈডাঙ্গা রেলব্রিজ অপারেশন। বর্তমান ভাঙ্গুড়া থানার অন্তর্গত এ-ব্রিজ দিয়ে পাকআর্মি উল্লাপাড়া থেকে চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া যাতায়াত করত। তাই রেল লাইন সচল রাখার জন্য প্রায় শ-খানেক রাজাকার ব্রিজ পাহারা দিত। ২৮শে আগস্ট সন্ধ্যায় কমান্ডার এস এম মোজাহারুল ইসলামের নেতৃত্বে ৮-১০ জন মুক্তিযোদ্ধা অতর্কিতে ব্রিজ আক্রমণ করেন। এতে প্রায় অর্ধশত রাজাকার নিহত হয়। তাদের মধ্যে চাটমোহরের ছিল ১৪ জন। এ অপারেশনে ৪২টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
৪ঠা সেপ্টেম্বর পরিচালিত হয় গফুরাবাদ রেলওয়ে স্টেশন অপারেশন। গফুরাবাদ স্টেশনে রাজাকারদের একটি শক্তিশালী ক্যাম্প ছিল। দিনের বেলায় পাক আর্মি ও মিলিশিয়ারা এখানে আসত, কিন্তু রাতে থাকত না। রাতের বেলা রাজাকাররা বাঙ্কারে অবস্থান করত। ঘটনার দিন রাত সাড়ে দশটার দিকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ধানবিলা গ্রামের তফিজ উদ্দিন ডিলারের বাড়িতে আহার গ্রহণের পরপর বিষয়টি অবগত হয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করেন। রাজাকাররাও পাল্টা আক্রমণ করে। কিন্তু তারা বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে বাঙ্কার ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। মুক্তিবাহিনী, – মুজিব বাহিনী ও সহযোযোদ্ধা মিলে তিনটি গ্রুপ এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করে। কমান্ডার এস এম মোজাহারুল হকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীতে ছিলেন আজাহার আলী, আফসার আলী, আক্কাছ আলী, আকবর আলী, আব্দুল জব্বার, আব্দুর রহিম, তোরাব আলী, মনজুর রহমান, আব্দুস সাত্তার এবং আব্দুল ওহাব হাবিবুর রহমান। মযহারুল ইসলাম কালুর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীতে ছিলেন ইদ্রিস আলী চঞ্চল, রওশন আলম, আছির উদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক, আফজাল হোসেন, অমল ডি কস্তা, ইগ্লাসিউস গমেজ এবং আমজাদ হোসেন লাল। আর সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন রহমান শেখ, হামিদ শেখ, মোহাম্মদ মোল্লা, বাছের প্রামাণিক, আরশেদ প্রামাণিক, মোন্তাজ আলী এবং আফসার আলী।
১৭ই সেপ্টেম্বর পরিচালিত হয় জোনাইল রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন। চাটমোহর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প ছিল হরিপুর ইউনিয়নের গোপালপুরে। এ ক্যাম্পে প্রায় দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করতেন। ক্যাম্প থেকে কিছু দূরে জোনাইলে ছিল রাজাকাদের একটি ক্যাম্প। ১১ জন রাজাকার সদস্যের এ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিল বড়াইগ্রাম উপজেলার চৌমান গ্রামের মোক্তার হোসেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এস এম মোজাহারুল ইসলামের নেতৃত্বে গোপালপুর ক্যাম্প থেকে ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধার এক চৌকস দল জোনাইল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। রাজাকাররা কোনো প্রকার বাধা না। দিয়ে বড়াইগ্রাম থানার দিকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর থেকে জোনাইল রাজাকার ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যায়। ৭ই অক্টোবর পরিচালিত হয় গুয়াখাড়া রেলস্টেশন অপারেশন। রামচন্দ্রপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মইজ উদ্দিন মাস্টারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা অবগত হন যে, গুয়াখাড়া রেলস্টেশনে পাঁচজন সশস্ত্র রাজাকার মো. মোত্তালেব হোসেন ফালু, ইয়াকুব মুন্সী, আব্দুস ছালাম, মো. হুজুর আলী এবং ওমর আলী সর্বদা অবস্থান করে। কমান্ডার এস এম মোজাহারুল ইসলাম তাঁর চাচা
মুক্তিযোদ্ধা আজাহারকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্প আক্রমণ করেন। কিন্তু রাজাকাররা কোনো পাল্টা জবাব দেয়নি। ফালু ও ইয়াকুব পালিয়ে থানায় আশ্রয় নেয় এবং ছালাম ও ওমর আলী আত্মসমর্পণ করে। পরে ওমর আলী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সাহসী ভূমিকা রাখে।
১১ই নভেম্বর ভোরে চাটমোহর উপজেলার সীমান্তে নওগাঁ যুদ্ধ (তাড়াশ) সংঘটিত হয়। তিন শতাধিক পাকসেনার সঙ্গে ৬৫- ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিলেন চাটমোহরের অধিবাসী। কয়েকশ সাধারণ মানুষও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে ১৩০ জন পাকসেনা এবং শতাধিক মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়। দুজন রাজাকারসহ ১০-১২ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করলে জনগণ তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন কমান্ডার গোলজার হোসেন (দেখুন – পলাশডাঙ্গা যুদ্ধ।
নওগাঁর যুদ্ধের পর ঐদিনই একদল পাঞ্জাবি সেনা নিমাইচরা ইউনিয়নের সমাজ গ্রামে প্রবেশ করে। অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজী এমপিএ-র বাড়ি ছিল এ গ্রামে। তাই এ গ্রামটি ছিল পাকবাহিনীর বিশেষ টার্গেট। পাঞ্জাবি সেনারা গ্রামে প্রবেশ করে সেখানকার বেশকিছু লোককে একত্রে জড়ো করে এবং রাজাকারদের সাহায্যে গ্রামের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা করে। এমন সময় পাঞ্জাবি সেনারা নওগাঁয় তাদের সহযোদ্ধাদের করুণ পরিণতির কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যায়। এর দুদিন পর ১৩ই নভেম্বর প্রায় হাজার খানেক পাকসেনা হান্ডিয়ালে প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য হান্ডিয়াল বাজার থেকে দুই কিমি দক্ষিণে শীতলাই জমিদার বাড়িতে অবস্থান নেন। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে কমান্ডার গোলজার হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার ব্রহ্মচারীর বাড়িসহ হান্ডিয়াল ও আশপাশের ৩৭৯টি বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ঐ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান যানবাহন ছিল নৌকা। তাই পাকসেনারা এলাকার প্রায় সমস্ত নৌকা পুড়িয়ে দেয়।
১১ই নভেম্বরের নওগাঁ যুদ্ধে বিপর্যয়ের ফলে পাকসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং তারা থানাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কমান্ডার গোলজার হোসেন, কমান্ডার মযহারুল ইসলাম কালু, ইদ্রিস আলী চঞ্চল লাল, কমান্ডার আমজাদ হোসেন এবং কমান্ডার মোজাম্মেল হক ময়েজের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর ৭০-৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা থানা ঘেরাও করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে রামনগর গ্রামের দুই সহোদর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন ও আবু তালেব মনে করেন মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করেছেন। তাই ১৩ই ডিসেম্বর ভোরবেলা তাঁরা থানায় ঢুকে পড়েন। সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। এতে ক্যাপ্টেন শের আফগানসহ ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। ছাইকোলা গ্রামের রবিউল ইসলাম নিমু এবং মন্ডতোষ গ্রামের ওমর আলী (রাজাকার থেকে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী) নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। ২০শে ডিসেম্বর থানায় অবস্থানরত ২২ জন মিলিশিয়া আত্মসমর্পণ করলে চাটমোহর থানা হানাদারমুক্ত হয়। থানা মুক্ত হওয়ার এ-যুদ্ধ – চাটমোহর থানা যুদ্ধ নামে পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধে চাটমোহর উপজেলার ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখ সমরে শহীদ হন। তাঁরা হলেন- মো. আমিনুর রহমান (পিতা খন্দকার আবুল কাশেম, গ্রাম সমাজ), মো. আব্দুস সাত্তার (পিতা জয়েন উদ্দিন খান, গ্রাম সমাজ), মোহাম্মদ আলী (পিতা মেছের পন্ডিত, গ্রাম সমাজ), মীর মফতুল হোসেন (পিতা মীর শাহাদত হোসেন, মহাদেবপুর), আবু তালেব (পিতা মেহের উদ্দিন মোল্লা, রামনগর), মোসলেম উদ্দিন (পিতা মেহের উদ্দিন মোল্লা, রামনগর), আজিত কুমার দে (পিতা হারান চন্দ্র দে, গুনাইগাছা), গোবিন্দ চন্দ্ৰ দে (পিতা সুধীর চন্দ্র দে, গুনাইগাছা), রবীন্দ্রনাথ গোস্বামী (পিতা ধীরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, গুনাইগাছা) এবং অনিল গোমেজ (পিতা বেচুমিন গোমেজ, মথুরাপুর)।
চাটমোহর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। গুনাইগাছা গ্রামের তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার দে, গোবিন্দচন্দ্র দে এবং রবীন্দ্রনাথ গোস্বামীর স্মরণে গুনাইগাছা হাট খোলায় ১৯৯৫ সালে স্থানীয় জনসাধারণের উদ্যোগে গুনাইগাছা শহীদ স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। এতে লেখা আছে ‘স্বাধীনতা সে আমার স্বজন হারিয়ে যাওয়া একমাত্র স্বজন’। স্মৃতিফলকটি নির্মাণে বাংলাদেশ মুক্ত নাটক দল সহযোগিতা করে। চাটমোহরের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা পাঁচুরিয়া গ্রামের মো. আমজাদ হোসেন লাল পাঁচুরিয়া থেকে খৈরাশ পর্যন্ত ৮ কিমি দীর্ঘ একটি রাস্তা নির্মাণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাদের স্মরণে এ রাস্তার নামকরণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা স্মরণী সড়ক। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন ও আবু তালেবের স্মরণে চাটমোহর থানা মোড় থেকে রামনগর পর্যন্ত প্রায় ৩ কিমি দীর্ঘ রাস্তার নাম রাখা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন ও আবু তালেব সড়ক। মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন লালের উদ্যোগে ১৯৯৮ সালে পাঁচুরিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রতিষ্ঠা করা হয় মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ২০০২ সালের ১৬ই মে চাটমোহর থানা সদরে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ স্মৃতি পাঠাগার। পাঠাগারটি বর্তমানে অবলুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মথুরাপুর বাইপাস মোড়ে স্থাপিত হয়েছে অনন্য ভাস্কর্য ‘অপ্রতিরোধ্য চাটমোহর’। ভাস্কর্যে একজন মহিলাসহ মোট পাঁচজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। তাদের চোখেমুখে স্বাধীনতার দ্বীপ্ত শপথ। ১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল পাকসেনারা চাটমোহরে হত্যা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে এখান থেকেই শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ। [মো. ছাবেদ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড