You dont have javascript enabled! Please enable it! চানগাছা হীরাজি পুকুরপাড় গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

চানগাছা হীরাজি পুকুরপাড় গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

চানগাছা হীরাজি পুকুরপাড় গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা) একাধিকবার সংঘটিত হয়। এতে বেশ কয়েকজন মানুষ শহীদ হন।
কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কের কাবিলা বাজারের পাশে মোকাম ইউনিয়নে চানগাছা গ্রামটি অবস্থিত। এ গ্রামের অদূরেই ময়নামতি সেনানিবাস। গ্রামের মধ্যেই রয়েছে হীরাজি পুকুরপাড়। এ গ্রামে কয়েকবার গণহত্যা সংঘটিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পার্শ্ববর্তী চান্দিনা, কচুয়া ও চাঁদপুরের অনেক শরণার্থী চানগাছা গ্রাম হয়ে দেবপুর-কংশনগর- বুড়িচং-শংকুচাইল দিয়ে ভারতে পাড়ি দিত। শরণার্থীরা গ্রামের জব্বার আলী ও মকবুল হোসেনের বাড়িতে বিশ্রাম নিত। ময়নামতি সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকার আবদুস সামাদ ও শফিক মিয়ার মাধ্যমে জব্বার আলী ও অন্যান্যের বাড়ি থেকে জোরপূর্বক মুরগি, চাল ইত্যাদি নিয়ে যেত। এ ধরনের জুলুম-অত্যাচারে গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
মে মাসে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিতে কয়েকবার আক্রমণ চালায় এবং কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এক শুক্রবারে কাবিলা বাজারের হাটবারের দিন পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দল গ্রামের হীরাজি পুকুরপাড়ে অবস্থান নেয়। বেলা ১১টার দিকে জব্বার আলীর বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে গ্রামবাসী ভয়ে পালাতে থাকে। তখন জব্বার আলীর বাড়ি ও পাশের বাড়ির শরণার্থীদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়। রাজাকার শফিকের চাহিদামতো জব্বার আলী ও আরো কয়েকজন পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য ৪০-৫০টি মুরগি ধরে রাখে। কথা ছিল পাকিস্তানি বাহিনী এরপর চলে যাবে। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জব্বার আলীসহ অন্য ৮ জনকে হীরাজি পুকুরপাড়ে নিয়ে যায় এবং লাইন করে দাঁড়াতে বলে। তাদের নির্দেশমতো তারা জামা-কাপড় না খুলতে চাইলে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী জব্বার আলীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং বাকিদের গুলি করে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ লাশগুলো পড়ে থাকে হীরাজি পুকুরে। এর মধ্যে কচুরিপানায় মাথা ডুবিয়ে আহত আবদুল মালেক ওরফে মালু মিয়া প্রাণে বেঁচে যায়। রাত ৮টার দিকে স্থানীয়রা নিহতদের পুকুরপাড়ে মাটিচাপা দেয়। হানাদার বাহিনী চলে যাবার সময় জব্বার আলীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এদিনের গণহত্যায় শহীদ ৮ জন হলেন— জব্বার আলী (৫৮), কন্দর আলী (২৫), আবদুল খালেক, দুলু মিয়া, আয়াত আলী (২৭), তাজুল ইসলাম (২৪), আলী আহাম্মদ (২৯) ও ফুল মিয়া (২২)। এ গণহত্যার মাস দুয়েক পর গ্রামের মকবুল হোসেন (৪২) ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আসেন। গোপনে খবর পেয়ে রাজাকার আবদুস সামাদসহ হানাদার বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে হীরাজি পুকুরপাড়ে হত্যা করে। পরিবারের লোকজন রাতে তাঁর লাশ বাড়ির পাশের কবরস্থানে দাফন করে। একই দিন রাজাকার আবদুস সামাদ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের খোঁজে এসে তাঁকে না পেয়ে তাঁর ভাই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র আবদুল হান্নানকে হীরাজি পুকুরপাড়ে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর গুলি করে হত্যা করে। তাকেও পারিবারিকভাবে দাফন করা হয়।
কয়েকমাস পর প্রায় ২০ জনের একটি শরণার্থী দল কাবিলা বাজার হয়ে চানগাছা গ্রাম অতিক্রম করছিল। তাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর আবদুস সামাদ ও শফিক মিয়া তাদের ধরে হীরাজি পুকুরপাড়ে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে দুজন যুবতী মেয়ে কাঞ্চন বালা ও মধু বালাকে তারা ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যায়। বাকিদের বিবস্ত্র করে গুলি করে হত্যা করে। পুকুরের পূর্বপাড়ে গ্রামবাসী লাশগুলোকে মাটিচাপা দেয়। এসব লাশের মধ্যে ছিল ৩ জন বৃদ্ধ, ৪ জন বৃদ্ধা, ৪ জন যুবক, ৩ জন মধ্যবয়স্ক মহিলা ও ৬ জন শিশু। দূর-দূরান্তের হওয়ায় তাদের পরিচয় জানা যায়নি। ২০১৯ সালে গণকবরটিতে একটি প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। [মামুন সিদ্দিকী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড