চরমুগরিয়া পাটগুদাম অপারেশন (মাদারীপুর সদর)
চরমুগরিয়া পাটগুদাম অপারেশন (মাদারীপুর সদর) পরিচালিত হয় দুবার ১৭ই জুন ও ২০শে আগস্ট। খলিল বাহিনী-র মুক্তিযোদ্ধারা এ অপারেশন পরিচালনা করেন এবং গুদামে আগুন ধরিয়ে দেন।
খলিল বাহিনীর কলাগাছিয়া ক্যাম্পে খবর আসে যে, চরমুগরিয়া সরকারি পাট ক্রয় কেন্দ্র জেটিসির গুদামে ৫ হাজার বেল্ট পাট বিদেশে রপ্তানির অপেক্ষায় আছে। এ পাট রপ্তানি করে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অস্ত্র কিনে নিরস্ত্র বাঙালিদের নিধন ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য ব্যয় করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর মুজিবনগর সরকার এর নির্দেশনা ছিল হানাদার পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়ার সব ব্যবস্থা করতে হবে। ১৭ই জুন রাতে মুক্তিযোদ্ধারা জেটিসির গুদামে বিস্ফোরক ও স্মোক গ্রেনেডের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে দেন। স্মোক গ্রেনেড ব্যবহার করায় পাট গুদামে দ্রুত আগুন লাগানো সম্ভব হয়।
দ্বিতীয় বারের অভিযান পরিচালিত হয় ২০শে আগস্ট। ১৫ই আগস্ট খলিলুর রহমান খান প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে ভারত থেকে কলাগাছিয়া ক্যাম্পে ফিরে আসেন। বিপুল পরিমাণ উন্নত হাতিয়ার হাতে পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নতুন অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, চরমুগরিয়া পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ এবং পাকবাহিনীর এ আর হাওলাদার জুটমিলস ক্যাম্পে মর্টার দিয়ে হামলা করা হবে। এ অপারেশনের জন্য ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। খলিলসহ ৫ জনকে নিয়ে একটি দল এবং তসলিম, কাজী আতিয়ার ও হারুন শরীফসহ ১২ জনকে নিয়ে আরেকটি দল গঠিত হয়। খলিল গ্রুপের দায়িত্ব ছিল এ আর হাওলাদার জুটমিলসে হামলা করে পাকসেনাদের ব্যস্ত রাখা, যাতে তারা সাহায্যের জন্য চরমুগরিয়া বন্দরে ছুটে আসতে না পারে। এ গ্রুপের সঙ্গে দেয়া হয় দুই ইঞ্চি মর্টার, ১টি এলএমজি, ১টি এসএলআর এবং কিছু বিস্ফোরক। চরমুগরিয়ার দলের সঙ্গে ১টি এলএমজি, ২টি এসএমজি ও কয়েকটি এসএলআর দেয়া হয়। তখন চারদিকে বন্যার পানি থইথই করছে। ২০শে আগস্ট সন্ধ্যায় দুটি ছোট নৌকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে বের হন। যাওয়ার পথে টেলিফোনের তার কেটে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। নৌকা দুটি খাগদি বাসস্টান্ডের দক্ষিণ পাশে মতি মাতব্বরের বাড়ির ঘাটে বেঁধে রেখে দুটি দল বন্দরের দিকে অগ্রসর হয়। খাগদি বাসস্টান্ড থেকে চরমুগরিয়া যেতে পুরো পথে ছিল কোমর সমান পানি। পানির মধ্য দিয়েই তাঁরা হেঁটে এগিয়ে চলেন। কুণ্ডু বাড়ির সামনে ডাউলের গালা পর্যন্ত পৌঁছতেই মাদারীপুর থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। অর্থাৎ খলিল গ্রুপ ততক্ষণে মর্টার থেকে সেনাক্যাম্পে গোলা ছোড়া শুরু করেছে। তখন প্রথম দল এসএলআর-এর গুলি ছুড়তে-ছুড়তে পোস্ট অফিস পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এ দলের দায়িত্ব ছিল চরমুগরিয়া বন্দরের রাজাকার- ও পুলিশদের ওপর গুলি ছুড়ে ভীত-সন্তস্ত্র করে রাখা এবং রাস্তা দিয়ে কোনো শত্রু এলে তাদের প্রতিরোধ করা। এদিকে পরিকল্পনা মাফিক দ্বিতীয় দল বন্দরের জেটিসি-সহ সব গুদামের পাটে আগুন দেয়। আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠলে দ্রুত উভয় দল একত্রিত হয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে- করতে খাগদি বাসস্ট্যান্ডে ফিরে আসে। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাযোগে নিরাপদে স্থানে ফিরে যান। অপারেশন সফল হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। এ অপারেশনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, পাটের গুদামে আগুন ধরাতে স্মোক গ্রেনেড খুব কার্যকর। মুক্তিযোদ্ধারা পরে এ গ্রেনেড অন্যত্রও ব্যবহার করেন। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড