You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চরফ্যাশন উপজেলা (ভোলা) - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চরফ্যাশন উপজেলা (ভোলা)

চরফ্যাশন উপজেলা (ভোলা) ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ১৯৬৮ সালে ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে এটি গঠিত হয়। ইউনিয়নগুলো হচ্ছে- ওসমানগঞ্জ, আছলামপুর, আমিনাবাদ, জিন্নাগড়, চরমাদ্রাজ, নীলকমল, নুরাবাদ, চরকলমী, চরমানিকা ও হাজারীগঞ্জ। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ – সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। সে আন্দোলনে সারা বাংলাদেশের মতো চরফ্যাশন থানার সর্বস্তরের মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণাসহ সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রামের আহ্বান জানান। তাঁর ভাষণে চরফ্যাশন থানার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
চরফ্যাশনের মানুষ অত্র এলাকা থেকে নির্বাচিত মো. মোতাহার উদ্দিন এমপিএ-এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আব্দুল মান্নান হাওলাদারকে সভাপতি ও ‘নেতাজী’ ছালামত উল্লাহ মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় চরফ্যাশন থানা সংগ্রাম কমিটি। এ কমিটির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে মকবুল আহাম্মদ খান, ডা. এ এইচ এম আব্দুল মতিন, হাজি জালাল আহমেদ মহাজন, প্রাণগোপাল দেবনাথ, আব্দুল আলী মাস্টার, আরব আলী মাস্টার, অধ্যাপক আব্দুল মালেক, ডা. রফিকুল ইসলাম, নূরুল ইসলাম নান্নু মিয়া, ইদ্রিস আলী মাস্টার, মেহেরুন নেছা রুশু, শাহ মো. মফিজুল ইসলাম, সেকান্দার আলী মিস্ত্রি, আনোয়ার হোসেন মিন্টু মিয়া, আব্দুল লতিফ পাটোয়ারি, মোহাম্মদ হোসেন, তছির আহমেদ মেম্বর প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য চরফ্যাশন থানার প্রতিটি ইউনিয়নেও সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আবদুর রব মিয়াকে সভাপতি, আবদুল মন্নান হাওলাদার ও আজিজুর রহমান পাটোয়ারীকে সহ-সভাপতি এবং ফজলুল করিম মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে আছলামপুর ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আবদুল লতিফ চেয়ারম্যানকে সভাপতি, সাহানুর আলম মিয়া ও আবদুর রশিদ পাটোয়ারীকে সহ-সভাপতি, মো. মোশারফ হোসেন মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক এবং আবি আবদুল্লাহ মিয়াকে দপ্তর সম্পাদক করে ওসমানগঞ্জ ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। মো. মোস্তফা মিয়াকে সভাপতি, কালিপদ সরকার ও মো. জয়নাল আবেদীন সরকারকে সহ- সভাপতি, মো. ছোবাহানকে সাধারণ সম্পাদক করে জিন্নাগড় ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। বকসি হাওলাদারকে সভাপতি, মিছির আহম্মেদ ভূঁইয়া, সামছুল হক মাস্টার ও ইব্রাহিম মাস্টারকে সহ-সভাপতি এবং মোহাম্মদ উল্লাহকে সাধারণ সম্পাদক করে নুরাবাদ ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। মুজাহার মাস্টারকে সভাপতি, জালাল আহম্মেদ মাস্টারকে সহ-সভাপতি এবং নাছির আহম্মেদকে সাধারণ সম্পাদক করে নীলকমল ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আবদুল গণি মিয়া চেয়ারম্যানকে সভাপতি, মো. ফয়েজ উল্লাহ মিয়া ও আলী আহমেদ মাস্টারকে সহ- সভাপতি এবং মোহাম্মদ আলী আকনকে সাধারণ সম্পাদক করে হাজারীগঞ্জ ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। মো. মোখলেছুর রহমান প-িতকে সভাপতি, রমিজউদ্দিন মোল্লাহ, নূরুল হক, মো. ইসমাইল ও এ বারীকে সহ- সভাপতি এবং আবদুস ছাত্তার মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে চর মানিকা ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। মো. ইদ্রিস মাস্টারকে সভাপতি, সামছুল আলম মাস্টার, ফয়েজ মিয়া ও জয়নাল মেম্বরকে সহ-সভাপতি এবং হাসানুজ্জামান মালতিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে চর মাদ্রাজ ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ফজলুর রহমান, নুরুল ইসলাম ভিপি, খোরশেদ মাঝি, আবদুস ছালাম, নাছির আহম্মদ দেওয়ান, এ কে এম আবদুস সামাদ, মো. তরিকুল ইসলাম, শফিকুল হক প্রমুখকে নিয়ে আমিনাবাদ ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে গঠিত হয় চরফ্যাশন থানা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আব্দুল কাইয়ুম মিয়া এর সভাপতি, হাসানুজ্জামান মালতিয়া, নেছার উদ্দিন ও আব্দুস ছালাম হাওলাদার সহ- সভাপতি, মোতাহারুল ইসলাম এর সাধারণ সম্পাদক, কার্তিক চন্দ্র সাহা, এ কে এম আবদুস সালাম ও শম্ভু কর্মকার সহ-সম্পাদক এবং শাহ আলম শরীফ, জাহাঙ্গীর হোসেন, আহম্মদ ফুয়াদ, রুহুল আমিন গোলদার, ওমর ফারুক খান, কার্তিক চন্দ্র দেবনাথ, মহিউদ্দিন মিয়া প্রমুখ এর সদস্য ছিলেন।
সংগ্রাম কমিটি ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে চরফ্যাশন খেলার মাঠে (বর্তমান স্টেডিয়াম) আনসার কমান্ডার জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে, আলীগাঁও ৩৫ নং তেলখালী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ওসমানগঞ্জের ব্রিটিশ সেনা সদস্য হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং লতিফ মিয়ার হাট জুনিয়র হাইস্কুল মাঠে ইপিআর-এর হাবিলদার আব্দুল খালেক হাওলাদারের নেতৃত্বে বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলে। এছাড়াও দুলারহাট, চৌমুহনী, ঘোষের হাট, চর মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আনসার কমান্ডার ইব্রাহীম, ল্যান্স নায়েক মফিজুল ইসলাম, হাবিলদার বেলায়েত হোসেন, নাজিম উদ্দিন প্রমুখের তত্ত্বাবধানে ছাত্র যুবকদেরকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চরফ্যাশন থানায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ঘাঁটি ছিল ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের লতিফ চেয়ারম্যানের বাড়ি এবং আমিনাবাদ ও ওসমানগঞ্জের মাঝামাঝি পেয়ার আলী বেপারীর চরাঞ্চলের বাড়ি। লতিফ চেয়ারম্যানের বাড়িতে মাঝে-মাঝে অবস্থান করে মো. মোতাহার উদ্দিন এমপিএ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালানায় দিকনির্দেশনা দিতেন। এছাড়াও আলীগাঁওর আবদুর মিয়ার বাড়ি, ওসমানগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা অলি দালালের বাড়ি, আবুবকরপুর আবু তাহের মিয়ার আবদুর রশিদ হাওলাদারের বাড়ি, আমিনাবাদ ইয়াকুব আলী মাঝির বাড়ি, কুতুবগঞ্জ মোস্তফা মেম্বারের বাড়ি ও কার্তিক স্বর্ণকারের বাড়িতে মাঝে- মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করতেন এবং তাঁদের নিরাপদ ঘাঁটি থেকে অত্র অঞ্চলে সফল অপারেশন পরিচালিত হতো। ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর ফ্যাশন নায়িবের পোল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
চরফ্যাশন থানায় যুদ্ধকালীন স্থানীয় কোনো কামান্ডার ছিলেন না। মজিবল হক সানু (মেহেন্দিগঞ্জ) থানা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। খণ্ডকালীন ট্রুপস কমান্ডার ছিলেন পাঁচজন। তাঁরা হলেন— কর্পোরাল মো. সিরাজুল ইসলাম (পিতা আমির হোসেন মুন্সী, ৪ নং ওয়ার্ড), হাবিলদার আব্দুল খালেক হাওলাদার (পিতা মো. এনজাদ আলী হাওলাদার, ওসমানগঞ্জ), নায়েক সুবেদার আব্দুর রব হাওলাদার (পিতা আব্দুল গফুর হাওলাদার, নুরাবাদ), হাবিলদার আব্দুল মোতালেব (পিতা পাঁচকড়ি ফরাজি, চর নুরুল আমিন) ও আব্দুল মোতালেব বকশি (পিতা ফজলে আহমেদ বকশি, ৭ নং ওয়ার্ড)। এছাড়া মোতাহার উদ্দিন মাস্টার এমপিএ, চরফ্যাশন থানা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আবদুল মান্নান হাওলাদার, সহ-সভাপতি মকবুল আহাম্মদ খান, সাধারণ সম্পাদক নেতাজি ছালামত উল্লাহ মিয়া, আবদুল আলী মাস্টার (নুরাবাদ), আবদুর রব হাওলাদার (জিন্নাগড়), আবদুল লতিফ মিয়া (ওসমানগঞ্জ), আবদুল গণি (হাজারীগঞ্জ), আবদুর রব মিয়া (আছলামপুর) প্রমুখ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৫ই মে পাকবাহিনী চরফ্যাশন থানায় অনুপ্রবেশ করে। তবে তারা স্থায়ীভাবে কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। চরফ্যাশন থানায় একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটি -, রাজাকার- ও – আলবদর বাহিনী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসংঘ-এর নেতৃবৃন্দ ও স্বাধীনতাবিরোধী স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় তারা ভোলা সদর থেকে চরফ্যাশনে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে মাঝে-মাঝে অবস্থান করত।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে চরফ্যাশনে শান্তি কমিটি, রাজাকার এবং আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে ছিল আব্দুর রব আনসারী (পিতা আসলাম হাওলাদার, চরফ্যাশন থানা মুসলিম লীগের সভাপতি ও থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, আছলামপুর), আমিরুজ্জামান মালতিয়া (পিতা ওয়াহেদ আলী মালতিয়া, চরফ্যাশন থানা শান্তি কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, জিন্নাগড়), ওয়ালি উল্লাহ মিয়া (পিতা আরব আলী হাওলাদার, চরফ্যাশন থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ও নেজামে ইসলামীর সভাপতি, জিন্নাগড়) এবং আব্দুর রব সিদ্দিকী (পিতা চান মিয়া হাওলাদার, চরফ্যাশন থানা শান্তি কমিটির জয়ন্ট সেক্রেটারি, জিন্নাগড়)।
এছাড়াও চরফ্যাশন থানার প্রতিটি ইউনিয়নে ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠিত হয়। আবদুর রব ছিদ্দিকী (পিতা চান মিয়া হাওলাদার, ৫নং ওয়ার্ড)কে সভাপতি, মোজাম্মেল হক পাটোয়ারী (পৌরসভা ৪নং ওয়ার্ড)কে সহ-সভাপতি, আবদুল মতিন (পিতা গনি চৌকিদার, ৭নং ওয়ার্ড)কে সাধারণ সম্পাদক এবং মাওলানা রফিউদ্দিন (পিতা মৌলবী তোফাজ্জল হোসেন, উত্তর মাদ্রাজ)কে প্রচার সম্পাদক করে জিন্নাগড় ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। আজাহার উদ্দিন মিয়া (পিতা হাজী আমিন মিয়া, ওসমানগঞ্জ)কে সভাপতি, সুলতান আহাম্মেদ মিয়া (ওসমানগঞ্জ) ও আলী হোসেন পাটওয়ারী (হাসানগঞ্জ)কে সহ-সভাপতি এবং ডা. মোশারেফ হোসেন (পিতা আলী আশরাফ প-িত, আবুবকরপুর)কে সাধারণ সম্পাদক করে ওসমানগঞ্জ ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। আবদুল আলিম (পিতা মতিয়ার রহমান, চেয়ারম্যান, ওমরপুর)কে সভাপতি, অলিউর রহমান হাওলাদার (পিতা আরব আলী হাওলাদার, আলীগাও) ও মাস্টার অহিদুর রহমান (ওমরপুর)কে সহ- সভাপতি এবং আবদুর রহিম মাস্টার (পিতা মতিউর রহমান, ওমরপুর)কে সাধারণ সম্পাদক করে আছলামপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। মাওলানা আবদুল কাদের খান (পিতা হাকিম আলী খান, আমিনাবাদ)কে সভাপতি এবং মাওলানা আবদুল বারী, আলী হোসেন রাড়ী, আবদুর রশিদ ফরাজীকে সদস্য করে আমিনাবাদ ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। বেলায়েত হোসেন মাস্টার (পিতা ফাজিলউদ্দিন ফরাজী, রসুলপুর)কে সভাপতি এবং আবদুল জলিল মাস্টার (পিতা মোমিন আলী, এওয়াজপুর), ছাদেক মাঝি (পিতা লুৎফুর রহমান মাঝি, রসুলপুর), ফজলে আলী খান (রসুলপুর), সুজাত হোসেন খলিফা (রসুলপুর) প্রমুখকে সদস্য করে চর মানিকা ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। মৌলভী মাহাবুবুর রহমান (পিতা মৌলভী আ. আজিজ, চর তোফাজ্জল)কে সভাপতি ও দেলোয়ার হোসেন মাস্টার (পিতা আবদুল কাদের খান, চর তোফাজ্জল), সামছল হক (পিতা হাজী আছলাম বুদ্ধি, চর তোফাজ্জল), সৈয়দ আহাম্মদ প-িত (পিতা ছলিমুদ্দিন মুন্সি, চর তোফাজ্জল)কে সহ- সভাপতি করে নুরাবাদ ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। তোফাজ্জল হোসেন হুকু মৌলভী (পিতা মোখলেছুর রহমান, চর যমুনা)কে সভাপতি এবং আবদুল বারেক তালুকদার (পিতা ইসমাইল তালুকদার, নীল কমল), জেবল হক কেরানী (পিতা আবদুল কাদের মুন্সি, চর যমুনা), নাদের আলী বেপারী (পিতা সংসর উদ্দিন, চর যমুনা)কে সহ-সভাপতি করে নীলকমল ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। সামছুদ্দিন মাস্টার (পিতা নোয়াব আলী খন্দকার, এওয়াজপুর), আমির হোসেন খন্দকার (পিতা মুকবুল খন্দকার, ওমরাবাজ), ছবর আলী দিদার (কদম আলী সিকদার, দক্ষিণ মাদ্রাজ), আবুল কাশেম মাস্টার (আবদুল কাদের মাঝি, দক্ষিণ মাদ্রাজ), খলিল হাওলাদার (হাজারীগঞ্জ) প্রমুখকে নিয়ে হাজারীগঞ্জ ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।
রাজাকারদের মধ্যে আবু তাহের দফাদার (চরফ্যাশন থানা রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার, ৬নং ওয়ার্ড), বেলায়েত হোসেন (চরফ্যাশন থানা রাজাকার বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার, ৪নং ওয়ার্ড), সদস্য আব্দুল মন্নান (৭নং ওয়ার্ড), দুলাল মিয়া (৫নং ওয়ার্ড), মহিউদ্দিন ক্বারী (৫নং ওয়ার্ড), মোশারেফ হোসেন (এওয়াজপুর), আবু তাহের (কাশেমগঞ্জ), আমির আলী (চর তোফাজ্জল), আব্দুল বারেক (চর তোফাজ্জল), শাহজাহান (চর যমুনা), আবুল কাশেম (নুরাবাদ), জেবল হক কমান্ডার (চর তোফাজ্জল), আবু দফাদার (চর নুরুল আমিন), আবু তাহের (চর নুরুল আমিন), নজরুল ইসলাম মুন্সী (ওসমানগঞ্জ), ইব্রাহীম বাঘা (চর মানিকা), খোরশেদ হাজী (উত্তর মাদ্রাজ), ইসমাইল কমান্ডার (ওমরপুর), মজিবল কানকাটা (ওমরপুর) এদের নাম উল্লেখযোগ্য।
আলবদর বাহিনীর মধ্যে মওলানা মো. মুজিবুর রহমান (চরফ্যাশন থানা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার, কুলছুমবাগ), মওলানা মো. ছিদ্দিক (চরফ্যাশন থানা আলবদর বাহিনীর সহকারী কমান্ডার, ৩নং ওয়ার্ড), মওলানা আব্দুল জলিল (চরফ্যাশন থানা আলবদর বাহিনী সহকারী কমান্ডার, ৭নং ওয়ার্ড), সদস্য নজরুল ইসলাম (চরফ্যাশন থানা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি, ১নং ওয়ার্ড), জাফর (৪নং ওয়ার্ড), বশির উল্লাহ (ওসমানগঞ্জ), ছাদুল্লাহ মুন্সী (চর নুরুল আমিন), আবু কালাম মৌলভী (চর নুরুল আমিন) প্রমুখ ছিল।
চরফ্যাশন থানায় স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পটি পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো
১৫ই মে পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় চরফ্যাশন বাজার, জিন্নাগড়, ভদ্রপাড়া, শরীফপাড়া প্রভৃতি গ্রামে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের ঘরবাড়িসহ হিন্দু বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। একই দিনে তারা আমিনাবাদের মাঝের হাট ও দুলারহাট বাজারে লুণ্ঠন শেষে। অগ্নিসংযোগ করে। ১১ই সেপ্টেম্বর সংগ্রাম কমিটির নেতা জালাল আহম্মদ মাস্টার (নীলকমল ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদের সহসভাপতি, চর যমুনা), আজিজুল হক বেপারী (দুলার হাট), মোহাম্মদ উল্লাহ কন্ট্রাক্টর (নুরাবাদ ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, চর তোফাজ্জল), নাছির আহাম্মেদ (চর যমুনা) পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ৩০শে সেপ্টেম্বর পেয়ার আলী বেপারী চরের যুদ্ধের – প্রতিশোধ নিতে ২রা অক্টোবর হানাদার বাহিনী চরফ্যাশন বাজার লুটপাট শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাদানের জন্য বাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাধা গোবিন্দ দেবনাথকে রাজাকাররা হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। তাকে চরফ্যাশন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে চরম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। রাজাকার আব্দুল মন্নান (৭নং ওয়ার্ড) ছিল খুবই প্রভাবশালী ও অত্যাচারী। তার নেতৃত্বেই চরফ্যাশন থানার ভেতরে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তার হাতে সব সময় কালো শক্ত লাঠি থাকত যা দ্বারা সে বিনা অপরাধে নিরীহ মানুষজনকে এলোপাথারি পিটিয়ে আনন্দ উপভোগ করত। আলবদর কমান্ডার মওলানা মো. মুজিবুর রহমান, মওলানা মো. ছিদ্দিক ও জাফর এরা বরিশাল থেকে বদরবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে চরফ্যাশনে স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা চালায়। শান্তি কমিটির সদস্য আবুল কালাম (পশ্চিম জিন্নাগড়)-এর কাজ ছিল কারা স্বাধীনতার পক্ষের লোক ও সংগ্রাম কমিটির নেতা, কোন বাড়ির ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছে, কোন বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি, কোনো হিন্দু বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছে কি-না, কেউ তাঁদের খাবার দিয়ে সাহায্য করেছে কি-না গোপনে এসব তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে জানানো।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হিন্দুবাড়ি থেকে ধান ক্রয় করার অপরাধে চর তোফাজ্জল গ্রামের ধান ব্যবসায়ী হাসান আলী মাঝিকে রাজাকার মজিবল হক মুন্সী (আলীগাঁও)-র নেতৃত্বে তার সহযোগীরা তাকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয় এবং হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা তার নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। কিন্তু টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাকে চরফ্যাশন রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন শেষে ভোলা খেয়াঘাটে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা আছলামপুর ইউনিয়নের খোদেজাবাগ গ্রামের হিন্দুবাড়ি ও আলীগাঁও গ্রামের নাপিত বাড়ি থেকে গরু-ছাগল পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যায়। তারা ভদ্রপাড়া পূজা মণ্ডপ ও মঠ ভাংচুর করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেয়ায় একই গ্রামের চরফ্যাশন কারামাতিয়া আলিয়া মাদ্রাসা মসজিদের ইমাম মীর মো. ইসরাইলকে ইমামের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করে এবং তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করে।
ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর ফ্যাশন গ্রামে বোরহানউদ্দিন থানার মুক্তিযোদ্ধা হাইকমান্ড সিদ্দিক মিয়ার বাহিনী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে-মাঝে অবস্থান করতেন। এজন্য অক্টোবর মাসে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকবাহিনী ঐ গ্রামে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। তারা ব্যবসায়ী রামচন্দ্র দাস ও তার পুত্র শংকর চন্দ্র দাসকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন সতীশ চন্দ্র হাওলাদারের বাড়িতে বেড়াতে এসে লালমোহন থানার মায়ার চর গ্রামের হরেন্দ্র চন্দ্র দাস হানাদার বাহিনী কর্তৃক হত্যার শিকার হয়। এরপর লুণ্ঠন শেষে তারা গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়।
চরফ্যাশন থানার আমিনাবাদ ও ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্যবর্তী পেয়ার আলী বেপারীর চরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। ৩০শে সেপ্টেম্বর রাজাকার বাহিনী সেখানে অতর্কিতে আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা <পেয়ার আলী বেপারীর চরের যুদ্ধ – নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার বেলায়েত হোসেনসহ ১৩ জন রাজাকার নিহত হয়।
২রা ডিসেম্বর হাই কমান্ড সিদ্দিকুর রহমান-এর নেতৃত্বে তার ট্রুপসের মুক্তিযোদ্ধা ও চরফ্যাশনের নুরুল ইসলাম বাবুল, মফিজুল ইসলাম, আলী হোসেন, সালাউদ্দিন মিয়া, সিরাজুল ইসলাম, নুরুর রহমান, হাবিলদার আব্দুল খালেক, আবুল কাশেম, ফকরুল আলম প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা চরফ্যাশন থানা দখল করলে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এ আক্রমণে সর্বস্তরের জনগণ তাঁদের সহযোগিতা করে। ২রা ডিসেম্বর চরফ্যাশন থানা হানাদারমুক্ত হয়।
চরফ্যাশনে ৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন— জালাল আহম্মদ মাস্টার (পিতা জুব্বার আলী মাঝি, চর যমুনা; ১১ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী কর্তৃক শহীদ), আজিজুল হক বেপারী (দুলার হাট, ১১ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), মোহাম্মদ উল্লাহ কন্ট্রাক্টর (পিতা আব্দুস সোবহান মাতব্বর, চর তোফাজ্জল; ১১ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), নাছির আহম্মদ (পিতা জালাল আহমদ মাস্টার, চর যমুনা; ১১ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), নুর সোলায়মান (পিতা মকবুল আহমেদ দেওয়ান, ওসমানগঞ্জ; ৩০শে সেপ্টেম্বর পেয়ার আলী বেপারীর চরের যুদ্ধে শহীদ), ওবায়েদুল হক (পিতা মোজাফর আলী, হাজারীগঞ্জ; বাংলাবাজার যুদ্ধে শহীদ), ল্যান্স নায়েক হাবিবুর রহমান (পিতা হাজী আলতাফ আহম্মেদ শেখ, চর নাজিমউদ্দিন; বোরহানউদ্দিনের যুদ্ধে শহীদ), ফজলুর রহমান (পিতা মকরম আলী শিকদার, পূর্ব মাদ্রাজ; বাংলাবাজার যুদ্ধে শহীদ) ও তোফাজ্জল হোসেন (পিতা নাদর আলী, শরীফপাড়া; বাংলাবাজার যুদ্ধে শহীদ)। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে চরফ্যাশন ট্যাফনাল ব্যারেট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। ১১ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী কর্তৃক শহীদ হওয়া সংগ্রাম কমিটির নেতা জালাল আহম্মদ মাস্টার, মোহাম্মদ উল্লাহ কন্ট্রাক্টর, আজিজুল হক বেপারী ও নাছির আহম্মদের স্মরণে নুরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। চরফ্যাশন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবুল কাশেমের নামে লারনার্স জোন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কাশেম ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর নামে জিন্নাগড় পৌরসভার শরীফপাড়া (৭নং ওয়ার্ড)-য় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম সড়ক। চরফ্যাশন থানা সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক নেতাজী ছালামত উল্লাহ মিয়ার নামে চরফ্যাশন কলেজ রোড থেকে বাইপাস সড়কের নামকরণ করা হয়েছে নেতাজী ছালামত উল্লাহ মিয়া বাইপাস সড়ক। এছাড়া চরফ্যাশন সরকারি কলেজে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল এবং ফ্যাশন স্কোয়ারে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নির্মিত হয়েছে। [মো. সিরাজুল ইসলাম ও মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড