চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং অপারেশন (চট্টগ্রাম শহর)
চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং অপারেশন (চট্টগ্রাম শহর) পরিচালিত হয় ৮ই সেপ্টেম্বর। এটি চট্টগ্রাম শহরের মুক্তিযুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন। এদিন চট্টগ্রাম জেলার বেসামরিক প্রশাসনের হেডকোয়ার্টার্স কোর্ট বিল্ডিং-এ টাইম বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকাটিকে কাঁপিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধা আবু সাইদ সরদার (পিতা আব্দুল হাই সরদার, সবুজবাগ, পানওয়ালাপাড়া) ও নূর মোহাম্মদ মিন্টি (আগ্রাবাদ ছোটপোল)।
এদিন ছিল পাকিস্তান সরকার ঘোষিত ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়নের শেষদিন। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কোর্ট বিল্ডিং-এর তৃতীয় তলার একটি কক্ষে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নবায়নের কাজ করা যাবে মর্মে কর্তৃপক্ষ রেডিওর মাধ্যমে পূর্বঘোষণা দিয়েছিল। নবায়নের স্থান ও তারিখ জেনে ঐদিন সেখানে একটি গেরিলা অপারেশনের পরিকল্পনা করেন গ্রুপ কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ-আল-হারুন। এর লক্ষ্য ছিল সামরিক জান্তার চট্টগ্রাম শহরস্থ প্রশাসনিক কেন্দ্রে আঘাত হানা। আবু সাঈদ সরদার এবং নূর মোহাম্মদ মিন্টি ছিলেন এ অপারেশনে মূল অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁরাই তা বাস্তবায়ন করেন। তবে অপারেশনের দিন জালাল উদ্দিন আহমেদ (পিতা আব্দুল মোনাফ সওদাগর, হাজীবাড়ি; ছাত্রলীগ নেতা) এবং তাঁর এক চাচা কোর্ট বিল্ডিং-এর নিচে অবস্থান নিয়ে তাঁদের বিশেষভাবে সহায়তা করেন। কোর্ট বিল্ডিং ভবনের লে-আউট এবং পাহাড়ের চারপাশের ম্যাপ সংগ্রহ করে তাঁরা কয়েকদিন ধরে রেকি করেন। তিন তলার যে কক্ষে অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন করা হয় তাঁরা সেটি দেখে আসেন। তারপর অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ৮ই সেপ্টেম্বর বেরিয়ে পড়েন কোর্ট বিল্ডিং-এর উদ্দেশে। একটি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে তাঁরা পাহাড়ের ওপর কোর্ট বিল্ডিং ভবনের সামনে নামেন। সকাল ১০টায় কেতাদুরস্ত সাহেবের বেশ ও ভঙ্গিতে নামেন আবু সাইদ সরদার। গলায় সোনার চেইন, হাতে রোলগোল্ডের ঘড়ি, পকেটে দামি কলম, পায়ে দামি স্যান্ডেল এবং হাতে একটি ছাতা। ছাতার ভেতর লুকিয়ে রাখা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি পেন্সিল আকৃতির টাইম বোমা। অপর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ মিন্টি ময়লা পোশাক- পরিচ্ছদে গোমস্তাবেশে হাতে একগাদা নথিপত্র বগলদাবা করে সাহেবের পেছনে অগ্রসর হতে থাকেন। তাঁরা নির্দিষ্ট কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং সতর্কতার সঙ্গে হাতের দামি ছাতাটিকে রেখে দেন দরজার পাশে। আশপাশটা ভালো করে দেখে যখন নিশ্চিত হন কেউ তাদের দেখছে না, তখন সাহেব ছদ্মবেশধারী মুক্তিযোদ্ধা ছাতার ভেতর হাতটা ঢুকিয়ে পেন্সিল টাইম বোমাটি সুইচ টিপে সক্রিয় করে কৌশলে তাঁরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসেন নিউ মার্কেটের সামনে। দুমিনিট পর বোমাটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। সেখানে পাকবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা এবং বেসামরিক কিছু লোক লাইসেন্স নবায়নের কাজে ব্যস্ত ছিল। বিস্ফোরণে পাকসেনা ও তাদের দোসরদের অন্তত ১২ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে দিনের বেলা সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সংঘটিত এ অপারেশনের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি – এবং অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে। অপারেশনে ব্যবহৃত ছাতাটি ছিল মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন আহমদ (আগ্রাবাদের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার), সালাহ উদ্দিন আহমদ ও জসিম উদ্দিন আহমদ- এর পিতা আবদুল মোনাফ সওদাগরের। তাঁর বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভরযোগ্য শেল্টার ও যোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কোর্ট বিল্ডিং-এ বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামে পাকিস্তান প্রশাসনের হৃদপিণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম হন। এ সফল অপারেশন চট্টগ্রাম শহরে যুদ্ধ পরিচালনায় অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। [জামাল উদ্দিন ও সাখাওয়াত হোসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড