চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট গণহত্যা (চট্টগ্রাম মহানগর)
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট গণহত্যা (চট্টগ্রাম মহানগর) সংঘটিত হয় ২৫শে মার্চ। এতে বহু বাঙালি সৈন্য নিহত হন। ২৪শে মার্চ জেনারেল আবদুল খামিদ খান (সেনাপ্রধান, পাকিস্তান আর্মি), মেজর জেনারেল নওয়াজেশ, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা (জিওসি, ১৪ ডিভিশন, ঢাকা), মেজর জেনারেল মিঠা খান, মেজর জেনারেল খোদাদাদ খান এবং ব্রিগেডিয়ার আনসারীসহ আরো কয়েকজন পাকিস্তানি ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসার হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আসে। তাদের আগমনের সঙ্গে-সঙ্গে ২০ বালুচের সিও লে. কর্নেল ফাতেমী ইবিআরসিতে আসে। ইবিআরসি মেসে ৩০-৪০ জন অবাঙালি অফিসার ছিল। রাতে সেখানে তাদের গোপন বৈঠক হয়। সে-রাতেই মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা গোপনে লে. কর্নেল ফাতেমীর কাছে অপারেশন সার্চলাইট-এর পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ইবিআরসি-র কমান্ড্যান্ট ও বাঙালি অফিসার ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ত্যাগ করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ বালুচ রেজিমেন্ট কর্তৃক ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে শুরু হয় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্বিচারে বাঙালি সৈন্যদের ওপর গণহত্যা। ব্যারাকে ঢুকে ঘুমন্ত বাঙালি সৈনিকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে ইবিআরসি-র ব্যারাক এবং ফ্যামিলি কোয়ার্টার্সগুলোতেও ভোর পর্যন্ত বাঙালিদের ওপর হত্যাকাণ্ড চলে। ভয়াবহ এ হত্যাকাণ্ডের খবর ষোলশহরে অবস্থানরত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের কাছে পৌঁছলেও তাঁদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এ-সময় মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে অনেকে রাতের আঁধারে স্টেশন সদর দপ্তর ত্যাগ করে কালুরঘাট ব্রিজের পূর্বপাশে বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা পাহাড়ে চলে যান। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া ও ক্যাপ্টেন এনামসহ কয়েকজন বাঙালি অফিসার ও কিছু সৈনিক জঙ্গল-টিলা বেয়ে বেরিয়ে প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইপিআর কোম্পানির বিপুল সংখ্যক সদস্য নিকটবর্তী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৭নং উইং-এর ‘এ’ কোম্পানির কমান্ডার সুবেদার আবদুল গণি চট্টগ্রাম সেক্টর থেকে বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে সকল অবাঙালিদের বন্দি করে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কাছে তাদের হস্তান্তর করেন। এরপর বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে তিনি ২৬শে মার্চ রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছান। তিনি সেনানিবাস থেকে পাকসেনাদের অগ্রাভিযানকে রোধ করার জন্য ঐদিনই নতুনপাড়া সেনানিবাসের উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থান নেন। একই দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ইপিআর- এর ২৮ জন সৈনিক এসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিক (এ আর মল্লিক), বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ শিক্ষক ও ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইপিআর বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। এ-সময় স্থানীয় বিপুল সংখ্যক জনতা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এবং পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে এখানে বহু লোক হতাহত হয়৷
২৮শে মার্চ বেলা ১টায় ক্যান্টনমেন্টের উত্তর-পূর্ব পাশে ইপিআর সুবেদার গণির অবস্থানের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারি, ট্যাংক, মর্টার এমনকি আকাশ-পথেও ব্যাপক আক্রমণ চালায়। ৩ ঘণ্টার তুমুল সংঘর্ষে পাকসেনারা পিছু হটলেও ইপিআর প্লাটুন কমান্ডার নায়েব সুবেদার নাজির আহমদ এবং অপর ৩ জন শহীদ হন। ইপিআর বাহিনীর বেশকিছু সৈন্য গুরুতর আহত হন।
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিহত বাঙালি সামরিক অফিসারদের কয়েকজন হলেন— লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী, (২৫শে মার্চ রাতে বেলুচ রেজিমেন্ট-এর সৈন্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ২৮শে মার্চ নির্মমভাবে হত্যা করে), লে. কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী (২৫শে মার্চ রাতে বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে), লে. কর্নেল ইঞ্জিনিয়ার এম এ কাদির (তেল ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী; তাঁর হাতেই ছিল তেল ও গ্যাসকূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি গুদাম খুলে দিয়ে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করেন। তাই তাঁকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৭ই এপ্রিল ধরে নিয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট নির্যাতনকেন্দ্রে হত্যা করে), মেজর এ কে এম আমিরুল ইসলাম (এএমসি, সেক্টর মেডিকেল অফিসার, ইপিআর, চট্টগ্রাম; ১৭ই এপ্রিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বন্দি অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয়), মেজর এম রেজাউল রহমান (এএমসি, সামরিক হাসপাতাল, চট্টগ্রাম সেনানিবাস; ২৬শে মার্চ তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিমর্মভাবে হত্যা করে), ক্যাপ্টেন এম হোসেন আকন্দ (ইএমই, ওয়ার্কশপ, চট্টগ্রাম সেনানিবাস; ২৯শে এপ্রিল সেনানিবাস অফিসে তাঁকে নির্যাতনপূর্বক হত্যা করা হয়), ক্যাপ্টেন খায়রুল বশর (এএমসি, অধিনায়ক, এসএসডি, চট্টগ্রাম সেনানিবাস; মে মাসে তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয়) ও লেফটেন্যান্ট আবু তালেব (এইসি, চট্টগ্রাম সেনানিবাস; ২৮শে মার্চ সেনানিবাসের বাসা থেকে তুলে নিয়ে বন্দি অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয়)। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে তাঁদের নামসহ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [জগন্নাথ বড়ুয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড