You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে গৌরীপুর উপজেলা (ময়মনসিংহ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে গৌরীপুর উপজেলা (ময়মনসিংহ)

গৌরীপুর উপজেলা (ময়মনসিংহ) মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈশ্বরগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৮২ সালের ১৫ই ডিসেম্বর এটি স্বতন্ত্র থানার মর্যাদা লাভ করে এবং পরে উপজেলায় উন্নীত হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হলে পুলিশের গুলিতে গৌরীপুর কলেজের ছাত্র আজিজুল হক হারুণ শহীদ হন। ১৯৭১ সালে ঈশ্বরগঞ্জ থানাকে ঘিরেই গৌরীপুরে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই হাতেম আলী মিয়া এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আব্দুস সোবহান, আশুতোষ রায়, সুলতান উদ্দিন তালুকদার, খালেদুজ্জামান, আসলাম ফকির, ছফির উদ্দিন, ছাত্রলীগ- নেতা ফজলুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে গৌরীপুরে মিছিল- মিটিং চলতে থাকে। একই সঙ্গে গৌরীপুর কলেজের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক সৈয়দ আল হাসানের উদ্যোগে গৌরীপুর কচিকাচা মাঠ ও গৌরীপুর কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এলাকার উৎসাহী ছাত্র-যুবকরা বাঁশের লাঠি, ডামি রাইফেল ইত্যাদি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। হাতেম আলী মিয়া এমপিএ-র বাসভবন-সংলগ্ন ইকবাল ক্লাবে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। এখান থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে ঢাকা ও ময়মনসিংহের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। ২৫শে মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক ঢাকায় ভয়াবহ গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর এই কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে গৌরীপুরের স্বাধীনতাকামী মানুষ জানতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ গৌরীপুরে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু (পিতা এম এন হোসেন, চান্দের সাধিয়া), রফিকুল ইসলাম (পিতা এলাহী বখশ, গাভী শিমুল) ও রজব আলী (পিতা আব্দুর রহিম, ভাতরা কান্দা)। পাকবাহিনী ২৩শে এপ্রিল গৌরীপুরে অনুপ্রবেশ করে এবং গৌরীপুর পুলিশ ফাঁড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। তার আগেই মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে গৌরীপুরে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আব্দুল হামিদ (বীরপুর, শান্তি কমিটির সভাপতি), ফখরুদ্দিন আহমেদ (কিল্লাতাজপুর), আব্দুল হামিদ চৌধুরী (নয়াপাড়া), সদর উদ্দিন মাস্টার (রামগোপালপুর), ইসরাফিল মিয়া (কালীখলা, অবাঙালি), ছলিম উদ্দিন (বিসকা), এ এফ এম নজমুল হুদা (চুরালী, পিডিপি- নেতা), হোসেন আলী (কোণাপাড়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী গৌরীপুরে প্রবেশ করলে দালাল আব্দুল হামিদ ও আব্দুল হামিদ চৌধুরী তাদের স্বাগত জানায়। তাদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী ব্রজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস (ছয়গন্ডা), কৃষ্ণ চন্দ্র সাহা (প্রতিমা সিনেমা হলের মালিক), চকপাড়ার জগৎ চন্দ্র নমদাশ ও ধীরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে। ২১শে আগস্ট এ এফ এম নজমুল হুদার সহযোগিতায় পাকবাহিনী হিন্দু অধ্যুষিত শালীহর গ্রামে ১৪ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং সৎকার ছাড়াই তাদের মাটিচাপা দেয়। হত্যার এ ঘটনা শালীহর গণহত্যা এবং কবরের স্থানটি শালীহর গণকবর- নামে পরিচিত। যুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দালালরা গৌরীপুর বাজার, শালীহর, বোকাইনগর, কোণাপাড়া প্রভৃতি গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
২১শে নভেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ কড়েহায় টহলরত মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এটি কড়েহা আক্রমণ নামে খ্যাত। ৩০শে নভেম্বর গৌরীপুর-ঈশ্বরগঞ্জ সীমান্তে পলাশকান্দা নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনী-র মুক্তিযোদ্ধাদের এক যুদ্ধ হয়, যা পলাশকান্দা যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং ৩ জন আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। হানাদাররা তাঁদেরও নির্যাতনের পর হত্যা করে। ৭ই ডিসেম্বর গৌরীপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এ দিনটি গৌরীপুর মুক্তদিবস হিসেবে পালিত হয়।
গৌরীপুরে দশজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন– হাতেম আলী (পিতা আফছর উদ্দিন, দামগাঁও), আহেজ উদ্দিন (পিতা নবী হোসেন, নব বালিজুড়ি), মতিউর রহমান (পিতা নজম আলী, বীর আহাম্মদপুর), আনোয়ারুল ইসলাম দুলাল (পিতা আব্দুল মন্নাফ, বাঙ্গুরিহাটি), সিদ্দিকুর রহমান (পিতা কুতুবউদ্দিন, গিধাঊষা), আব্দুল হাই (পিতা নায়েব আলী, পাচার), এ কে এম সিরাজুল ইসলাম (পিতা মনফর উদ্দিন, বোকাইনগর), জসিম উদ্দিন (পিতা মেয়াসর আলী, কাউরাট), আব্দুল মজিদ (পিতা মাজেদ আলী, লক্ষ্মীপুর) ও আফাজ উদ্দিন (পিতা আব্দুল লতিফ, ভুলার আলগি)।
গৌরীপুর বাজারে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ, উপজেলা পরিষদের পুকুরপাড়ে গৌরীপুর ‘বিজয় ৭১’ নামে স্মৃতিস্তম্ভ এবং শালীহর গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [খায়রুল বাশার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড