গোয়াইনঘাট পাকসেনা ক্যাম্প অপারেশন (গোয়াইনঘাট, সিলেট)
গোয়াইনঘাট পাকসেনা ক্যাম্প অপারেশন (গোয়াইনঘাট, সিলেট) পরিচালিত হয় ২৪শে অক্টোবর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়েকবার। শেষ অপারেশনে গোইনঘাট শত্রুমুক্ত হয়।
গোয়াইনঘাট সিলেট জেলার একটি সীমান্তবর্তী থানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি ৫নং সেক্টরের ডাউকি সাব-সেক্টরের অধীনে ছিল। সুরমা নদী এই থানাকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। সীমান্তবর্তী থানা সদর এবং সিলেট-তামাবিল- ডাউকি-শিলং এক্সিসের অতি নিকটে অবস্থানের কারণে ১৯৭১ সালে উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে গোয়াইনঘাট ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। সিলেট শহরের প্রতিরক্ষার জন্য এ অবস্থানটি নিজের দখলে রাখা যেমন পাকিস্তানিদের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সিলেট শহর মুক্ত করার জন্য এ থানা শহরটি মুক্ত করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা সুরমা নদীর পূর্ব পাড়ে আজির উদ্দিন চেয়ারম্যানের বিশাল পাকা ভবনে সদর দপ্তর স্থাপন করে নদীর তীর ঘেঁষে পুরো এলাকা নিয়ে একটি শক্ত প্রতিরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তুলেছিল। পশ্চিমে ভোলাগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ, উত্তরে রাধানগর, জাফলং বাজার, জৈন্তাপুর ও সারিঘাট এবং পূর্বে দরবক্স, মুক্তাপুর ও কানাইঘাট পর্যন্ত এলাকার প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর ছিল এই গোয়াইনঘাট। আজির উদ্দিনের বাড়ির উল্টোদিকে পাকিস্তানি বাহিনী একটি হেলিপ্যাডও তৈরি করেছিল। এই ব্রিগেডের সদর দপ্তর ছিল খাদিমনগর এবং ব্রিগেড কামান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহ। গোয়াইনঘাটের প্রতিরক্ষা কাজে ৩১ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি, ১২ এ কে এফ (আজাদ কাশ্মীর ফোর্স), পাঞ্জাব রেঞ্জার ও টসি ব্যাটালিয়নের মিশ্রিত এক কোম্পানি সৈন্য এবং এক কোম্পানি সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর সদস্য সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত ছিল।
গোয়াইনঘাট পাকিস্তানি হানাদারদের শক্ত ঘাঁটি হয়ার কারণে কয়েক ধাপে এখানে তাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ২৪শে অক্টোবর গোয়াইনঘাটে প্রথম অপারেশনটি পরিচালিত হয়। ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের অধীনে লেফটেন্যান্ট ইয়ামীন চৌধুরীর এফএফ কোম্পানি, লেফটেন্যান্ট মঞ্জুরের নেতৃত্বে তৃতীয় বেঙ্গলের আলফা এবং লেফটেন্যান্ট নূরন্নবীর ডেল্টা কোম্পানি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। লেফটেন্যান্ট নূরন্নবীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি ক্যাম্পে পরিচালিত প্রথম আক্রমণ ব্যর্থ হয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধারা হায়দারপুর এলাকায় পিছু হটতে বাধ্য হন। তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীর নেতৃত্বে দীর্ঘ এক মাস স্থায়ী রাধানগর সিজ অপারেশনের মাধ্যমে ২৮শে নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর রাধানগর কমপ্লেক্সের প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর ছোটখেল অবস্থানটির পতন ঘটে। ৩০শে নভেম্বর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টর ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট নূরন্নবীর নেতৃত্বে রাধানগরে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী সীমান্তবর্তী প্রতিরক্ষা কমপ্লেক্সটির পতন ঘটে। রাধানগর সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়।
১লা ডিসেম্বর তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট নূরন্নবীকে গোয়াইনঘাট অপারেশনের অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। লেফটেন্যান্ট নবী মূল আক্রমণের জন্য তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ডেল্টা কোম্পানি এবং লেফটেন্যান্ট ইয়ামীনের এফএফ কোম্পানিকে নির্বাচিত করেন। ৩রা ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যে সবকিছু পরিকল্পনামতো হয়েছে কি-না দেখে নিয়ে ৪ঠা ডিসেম্বর ভোর ৪টায় গোয়াইনঘাটের ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। ভোর ৩টা ৪৫ মিনিট থেকে উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের অবস্থান লক্ষ করে প্রচণ্ড গোলাগুলি নিক্ষেপ শুরু হয়। ভোর ৫টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প আজির উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ির উল্টো দিকে সড়ক সংলগ্ন বিশাল আয়তনের পুকুড় পাড়ে আড়ালে সমবেত হয়। কিছুক্ষণ পর তারা ধানক্ষেতের মাঠ ধরে খাদিম নগরের দিকে পশ্চাদপসরণ করতে শুরু করে। ৫টা ৪৫ মিনিটে গোয়াইনঘাট পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের পতনের মধ্য দিয়ে গোয়াইনঘাট শত্রুমুক্ত হয়। এ ক্যাম্পের পতনের মধ্যে দিয়ে সিলেট-তামাবিল-ডাউকি-শিলং এক্সিসে শত্রুর সর্বশেষ সীমান্তবর্তী শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানের পতন ঘটে। সকাল ৬টার দিকে গোয়াইনঘাটের ফেরিঘাট এলাকায় একটি লম্বা বাঁশের মাথায় অপারেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট নবী মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে গোয়াইনঘাট শত্রুমুক্ত হওয়ার সুসংবাদ সকলকে পৌঁছে দেন।
ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল, লেফটেন্যান্ট নূরন্নবী, লেফটেন্যান্ট ইয়ামীন, লেফটেন্যান্ট মঞ্জুর, সুবেদার মোশাররফ ও সুবেদার বদির নেতৃত্বাধীন এ-যুদ্ধ সিলেট রণাঙ্গনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। গোয়াইনঘাট হাতছাড়া হয়ে যাবার পর পাকিস্তানিদের সিলেট শহরের আশপাশের পাহাড়গুলোতে অবস্থান নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে গোয়াইনঘাট সেনাক্যাম্প দখলের পর সরাসরি সিলেট শহরে অপারেশন পরিচালনা সহজতর হয়। মুক্তিবাহিনী এ অঞ্চলের মূল ঘাঁটি সিলেটের দিকে দৃঢ় মনোবল ও অনুপ্রেরণা নিয়ে অভিযান শুরু করে। অন্যদিকে গোয়াইনঘাট সেনা ক্যাম্প দখলের ফলে মিত্রবাহিনী-র কাছে মুক্তিবাহিনীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। [তপন পালিত]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড